আ'বিমা(মাটির মা/উর্বর ভূমি)

 আ'বিমা(মাটির মা/উর্বর ভূমি)












যখন মধুপুরের ইস্যু সামনে চলে আসে তখন বার বার গারো তথা আদিবাসীদের অবিসংবাদিত নেতা প্রয়াত

ফা গারো রাজা পরেশ চন্দ্র মৃ এর উক্তি মনে পড়ে," আমরা বনের সন্তান।বনে আমাদের জন্ম।বনেই আমরা বেড়ে উঠেছি।এই বনজীবনে আমরা এতটাই অভ্যস্ত যে,এই গ্রাম এবং এই বন ছেড়ে আমরা কোথাও যাবো না।কারণ বন ছাড়া আমরা বাঁচতে পারবো না।"


মধুপুর গড় অঞ্চলকে 'গারো' জনগোষ্ঠী 'আ'বিমা' বলে ডাকে। বাংলা অর্থ মাটির মা/উর্বর ভূমি।যে ভূমিতে তখনকার রাজা শ্রী যোগীন্দ্রনাথ রায় বাহাদুরের সাথে ১৮৬০ সালে গারো গ্রাম প্রধানদের সাথে একটি চুক্তি করেন এবং তখন থেকে রাজাকে খাজনা দেওয়া আরম্ভ হয়। যা দেশ স্বাধীনতার পরেও ১৯৮২ সাল অব্দি খাজনা নেওয়া হতো।পরবর্তীতে তা বন্ধ রাখা হয়,যা এখন অব্দি বন্ধ।ব্যাপারটা বুঝতে হবে যে, বনবিভাগের জন্ম ১৯২৭ সালে।সুতরাং ব্রিটিশ আমলের আগে থেকেই মধুপুর গড় অঞ্চলে আদিবাসীদের(গারো,কোচ,বমর্ণ) বসবাস ছিল।যার সাক্ষী হয়ে আছে ব্রিটিশ আমলের সময়ের স্কুলগুলো ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্থাপনা।


প্রাণ প্রকৃতি নিয়ে জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িত।যেখানে বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত, ঝর্ণা সেখানেই কেন আদিবাসীদের বসবাস(!)কেনইবা আদিবাসীরা এই বন,এই পাহাড়,এই ঝর্ণা,এই পাথর, এই ঔষুধি গাছ, এই ফুলফল নিয়ে আকড়ে ধরে বাঁচতে চাই।কারণ যাদের সাথে, মা-মানুষ-মাটি প্রকৃতির সাথে নিবিড় সম্পর্ক তারাই  জানে এই প্রকৃতি'তে প্রকৃতির নিয়ম ব্যাহত করলে কী ফল হতে পারে(?)।প্রকৃতির নিয়ম তোয়াক্কা না করলে, পরবর্তীতে সে-টার ফল ভুগতে হয় সকল জীবজন্তুকে।

সুতরাং পশুপাখি মানুষের জন্য যেমন বন দরকার, সেইভাবে প্রকৃতির বিশুদ্ধতার জন্যও বন-জঙ্গল প্রচুর পরিমাণে দরকার।পাঠ্যবইয়ে ছোটবেলায় পড়েছিলাম একটি দেশে ২৫ শতাংশ বন থাকা আবশ্যক।কিন্তুু আমাদের দেশে কত শতাংশ এখন বন আছে বলাই বাহুল্য! চাকমা রাজা দেবাশীষ রায়ের কথা মনে পড়ে তিনি বলেছিলেন,"যখন বন ছিল, তখন বন বিভাগ ছিল না। বন বিভাগ সৃষ্টি হওয়ার পরই বন ধ্বংস শুরু হয়েছে।"


বাস্তবতা দেখে চাকমা রাজার কথার সাথে একমত না হয়ে পারি না।ছোটবেলায় মধুপুরে যে বন-জঙ্গল দেখেছিলাম তেমনটা আর নেই।যারা বনরক্ষার দায়িত্বে আছেন,তারা কতটুকু বন বুঝেন তা জানি না,তবে কীভাবে বন ধ্বংসের পাঁয়তারা করা যায় তা ভালো করেই বুঝেন।আজকে বন কমে যাওয়া, বনের সম্পদ লুটপাট, পশুপাখির থাকার জায়গা, বাস্তুসংস্থান চক্রের যে পরিণতি তা বনবিভাগ(কর্মকর্তা) দায় এড়াতে পারে না।আপনারা অনেকেই মধুপুরের চলমান সমস্যা নিয়ে অবগত আছেন।এই সমস্যা দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব থেকেই,তবুও এই সমস্যা স্বাধীন দেশেও চলমান।স্থানীয় আদিবাসীরা(গারো,কোচ,বমর্ণ) ধারাবাহিক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এখনো বনের চিহ্নটুকু টিকিয়ে রেখেছে।আর কত দিনইবা আন্দোলন জারি রাখতে পারবে?বন টিকিয়ে রাখতে রাষ্ট্রের সদিচ্ছা না থাকলে কী বনরক্ষা করা যাবে।বিভিন্ন সরকারের সময় জাতীয় উদ্যান, ইকোপার্ক, ইকো ট্যুরিজম, ফায়ারিং রেঞ্জ ও সংরক্ষিত বনভূমি ঘোষণার নামে আদিবাসীদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদের নীল নকশা করেছে।উচ্ছেদও করেছে কিন্তুু আজও ক্ষতিপূরণ পাইনি।এই যে আদিবাসীদের উচ্ছেদের আতঙ্ক ও বনরক্ষার যে আন্দোলন তা কিন্তুু আজ অবধি চলমান।আপনারা জানেন,গত ৩০ মে'২১ মধুপুরের টেলকী বাজারে ছাত্র-জনতার ব্যানারে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল বের করা হয়।সেই মানববন্ধনে সুস্পষ্টভাবে চারদফা দাবী

উত্থাপন করা হয়।দাবিগুলো হল-

(১)"টেলকী গ্রামে তথাকথিত আরবোরেটামের নামে আদিবাসীদের শতাব্দী প্রাচীন শ্মশানের স্থানে প্রাচীর নির্মাণ ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য স্থাপনাসহ প্রকল্প বাস্তবায়ন অবিলম্বে বন্ধ করা, (২)আদিবাসীদের স্বত্বদখলীয় কৃষি ও ফসলি জমিতে কোনো ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন না করা,(৩) জাতীয় উদ্যান ও সংরক্ষিত বনভূমি ঘোষণা বাতিল করে আদিবাসী উচ্ছেদ বন্ধ করা এবং(৪) আদিবাসী প্রথাগত ভূমি অধিকারের স্বীকৃতি প্রদান ও সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠন করা"।ন্যায্য দাবিগুলো রাষ্ট্রের কাছে চাওয়া কী ভুল!



বনবিভাগের অপকর্মে কেন স্থানীয় সম্প্রদায় ও দেশের জনগন ভুগবে,প্রশ্ন রেখে গেলাম।এর কোনদিন ন্যায্য সুরাহা হবে কিনা জানি না!তবে এইটা জানি,যতদিন রাষ্ট্র বুঝবেনা জানার চেষ্টা করবে না মূল সমস্যা,ততদিন সমস্যা থেকেই যাবে। রাষ্ট্র কবে বুঝবে বন ধ্বংস করে রেস্ট হাউজ বানালে উন্নয় হয় না।বিশুদ্ধ বাতাসের পরিবর্তে এসির(বাতাস) ঠাণ্ডা কী ভালো(?)।প্রচন্ড গরমে তাপদাহে গাছের নিচে কী শান্তি নাই(?)।বন উজাড় করলে প্রাণ বৈচিত্রের সমারহ কী ঘটবে,চার দেওয়ালে আদৌ কী সম্ভব।প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে সামাজিক বনায়নের নামে যে বিদেশী গাছ লাগানো হয় তাতে বনের সৃজন হয় না আরো বন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়াই।শালবনের ভেতরে সারি সারি নানা জাতের গাছ লাগালে বনের উন্নয়ন হয় না।বনের নানা জাতের ঔষুধি গাছ,নানা জাতের অর্কিড, বিভিন্ন ধরণের গাছপালা কেটে ফেলে পরিষ্কার করলে বনের সৃজন হয় না,বন সমৃদ্ধি লাভ করে না।শালবনে গাছের গুড়ায় গোবর দিলে তাতে কী গাছ বেশি সুন্দর হয়,পুষ্টি পায়? বনের মাঝখানে ইটের দেওয়াল, বিন্ডিং দিলে কী বন কি আর বন থাকে!রাতে আধারে কাঠচুরি করলে কী আর গাছ থাকে,শতশত মিথ্যা মামলা করলে কী আর আসল ব্যক্তি দোষীসাবস্ত্য হয়।এমন নানা প্রশ্ন করা যায়,কার কাছে সুরাহা চাইবো।যারা দায়িত্বে আছেন,তারাই বন ধ্বংসের মূল হোতা।কাকে কী বলব?


বন পাহাড় রক্ষায় আদিবাসীরা যেমন সচেষ্ট তেমনি বনবিভাগ একটু সচেষ্ট হলেই কিন্তুু এই বনগুলো রক্ষাপেতো।মধুপুরে যে চলমান আন্দোলন তা কিন্তুু চলছেই অন্যদিকে সাংসারেক ধর্মবলাম্বীদের প্রাচীন শ্মশানের(মাংরুদাম) উপর প্রাচীর দেওয়া ও প্রকল্পের অন্যান্য স্থাপনা জোরেশোরে কাজ চলছেই।ইর্কো ট্যুরিজমের নামে যে সুফল প্রকল্পের কাজ চলমান ও মধুপুরের বন ধ্বংসের যে চক্রান্ত চলছে,তা আদৌ দেশের জন্য ভালো হবে কি?প্রাকৃতিক কাজ কেটে, স্থানীয় গাছগুলো সংরক্ষণ না করে,নতুন করে গাছ লাগিয়ে কী গবেষণা হবে আমার বোধ্যগম নয়। কিছু স্থানীয় নেতৃবৃন্দ জড়িত আছে বলে জানা যায়, যারা 'কোদাল মারা কমিটি' নামে পরিচিত পেয়েছে।যাদের কারণে দীর্ঘস্থায়ী সংকট সৃষ্টি হয়েছে/হচ্ছে।


সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে দেশের আদিবাসীদের দুর্দশাপন্ন অবস্থা জানতে পারি।মধুপুরে আন্দোলন চলমান,যেখানে এখনো সুষ্ঠু সমাধানের আলো দেখা যাচ্ছে না।সেই আলো না দেখতেই জানতে পারলাম,মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার আগারপুঞ্জির খাসিয়াদের প্রায় এক হাজারে অধিক পান গাছ কেটে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা।যে পানে ৪৮ টা পরিবার নির্ভর করে সংসারের যাবতী খরচ বহণ করে। সে-ই প্রধান আয়ের উৎস পান কেটে দিলে বেঁচের থাকার চাহিদা কী থাকে।এমন ঘটনা প্রথম নয়,দিনদিন আদিবাসীদের উপর এমন হামলা বাড়ছে কেন?প্রশ্ন অনেক। উত্তর একটাই, কারণ বিচারহীনতা।



শেষে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের উক্তি দিয়ে শেষ করতে চাই। তিনি বলেছিলেন, "একটি দেশ কেমন চলছে তা বোঝার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো একজন আদিবাসী ছেলে বা মেয়েকে তা জিজ্ঞেস করা। দেশে বাঙালি বাদে অন্য জাতিসত্তার মানুষ তাদের ন্যায্য অধিকার পাচ্ছে না। তারা ভালো না থাকলে দেশও ভালো চলবে না"।


সুতরাং বুঝতেই পাচ্ছেন বনকে নিয়ে আদিবাসীরা কেন আকড়ে ধরে বাঁচতে চাই।বন পাহাড় নাই তো, আদিবাসীরা ভালো থাকবে না।যদি আদিবাসীরা ভালো না থাকে, দেশ কী ভালো থাকবে?



No comments

Theme images by saw. Powered by Blogger.