ফা সোনারাম আর সাংমা
ফা সোনারাম আর সাংমা
জাডিল মৃ(Jadil Mri)
তরুণ লেখক এবং ব্লগার
আমরা আমাদের ইতিহাস জানি না বিধায় নিজেকে ছোট জাত ভাবি,পরিচয় দিতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগি,আমাদের যদি ইতিহাস জানা থাকত, তাহলে এমন পরিস্থিতির শিকার হতে হতো না।যাই হোক,যার কথা বলার জন্য এত সামান্য দীর্ঘ লেকচার দিলাম সে আর কেউ নয় গারোদের প্রথম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যাকে প্রথম গারো রাজনীতিবিদ বলা হয় সে পা সোনারাম আর সাংমা।অনেকের কাছে নামটা নতুন মনে হতে পারে, অপ্রয়োজনীয় হতে পারে। কিন্তুু গারো হিসাবে তার অবদান অস্বীকার করার কোন পথ নাই।আমাদের কাছে হয়তো গুরুত্ব পাবে না বিষয়টা,কিন্তুু একজন গারো হিসাবে জাতির জন্য যে অবদান তা অস্বীকার করা মানে নিজেকে অস্বীকার করা।
তিনি এমনি এমনি ইতিহাসের পাতায় নাম লেখাননি, প্রতি বছর মানুষজন অযথা স্মরণ করে না,
বৃহৎ আকারে কাজ করেছেন বলেই রাজনৈতিক জীবনী মেঘালয় পাঠ্যপুস্তকে প্রণীত ও পঠিত।
তার কাজ সম্পর্ক আজকে সংক্ষিপ্ত আকারে আলোচনা করব।
পা সোনারাম আর সাংমা আনুমানিক জম্মগ্রহণ করেন ১৮৬৭ সালে পূর্ব গারো হিলসের অন্তর্গত গোয়ালপাড়া জেলা নামক রংরকগ্রী গ্রামে।পা সোনারাম আর সাংমা ছয় বোন ভাইদের মধ্যে দ্বিতীয় সন্তান।পা সোনারাম আর সাংমার ছোটবেলার জীবন অত সুখকর ছিল না, অনেক কষ্ট করে জীবন যাপন করতে হয়েছিল।ছোটবেলায় নিজের স্ব- ইচ্ছায় ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে নিশান গ্রামে ভর্তি হন এল.পি স্কুলে।এল.পি স্কুল শেষ করে ভর্তি হন টুরা আপার প্রাইমারীতে ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে,পরবর্তীতেকালে নর্মাল স্কুল পাশ করেন ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে।পড়াশুনা খুব ভালো ছিলেন তেমনটা নয়,কিন্তুু নিজের ইচ্ছায় অনেক দূর পড়াশুনা করেছিলেন।জানা যায়,সাংসারেক ধর্ম বাদ দিয়ে যীশু খ্রিস্টকে ত্রাণকর্তা হিসাবে গ্রহণ করে ১ফেব্রুয়ারি ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে।পা সোনারাম আর সাংমা টকজে গাবিল মমিনকে জীবন সঙ্গীনি হিসাবে বিবাহ করেন ৭জুন ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে।তিনি তিন কন্যা এবং তিন পুত্রের জনক ছিলেন। কর্মময় জীবনে পা সোনারাম আর সাংমা ব্রিটিশ সরকারের অধীনে ১১ বছর চাকরি করেন।এর মধ্য ১০ বছর মুহুরী এবং ভেসিলেশন ইন্সপেক্টর পদে ১ বছর।চাকরী সুবাদে ভিন্ন ভিন্ন গারো এলাকা পরিদর্শন করতে পেরেছিল বলে নিজের চোখে গারোদের দুঃখ, কষ্ট,অভাব অভিযোগ,আশা আকাঙ্ক্ষা, শোষণ,পরাধীনতা,সরকারের জুলুম,অত্যাচার,সরকার নিজেই আইন ভঙ্গ করত,জামিদারদের হয়রানি, এই সব বাস্তত অভিজ্ঞতা অর্জনে সুযোগ পেয়েছিলেন।ফলত নিজের মধ্যে জাতির জন্য কিছু করার তাগিদা অনুভব করেন।বিভিন্ন এলাকা যাওয়ার সুবাদে গ্রামের নকমা ও লস্করদের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠে।ব্রিটিশ সরকারের উপর গারোদের অনেক ক্ষোভ জম্ম নেয়,তার মধ্যে অন্যতম গারো এলাকাকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা,বেগার প্রথা চালু,গারো এলাকা সীমানা নিয়ে বিজনী জমিদারদের সাথে বিরোধ।অন্যদিকে,প্রথমবারের মত গারো হিলসে ভৌগোলিক সীমারেখা নির্ধারণ করে ব্রিটিশ সার্ভেয়ার মি.কেলসো ১৮৪৯-১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে, যা গারোদের কাছে কোনভাবে গ্রহণযোগ্য ছিল না, কারণ অনেক গারো জনপদ বাদ পড়েছিল।এই সীমারেখা নিয়ে গারোদের মাঝে তীব্র ক্ষোভ জম্ম নেয়।সেই সময়ে পুরো গারো জাতি ব্রিটিশ সরকারের সীমারেখা প্রত্যাখ্যান করে।ফলে ব্রিটিশ সরকার পুনরায় সীমারেখা নির্ধারণে বাধ্য হয়।কিন্তুু শেষ পর্যন্ত শত আনন্দোলন করেও তার সুফল আনতে পারেনি।
সময়ের কাল স্রোতে গারো জাতির মধ্যে ক্ষোভ অসন্তোষ তীব্র আকারে বাড়তে থাকে,ব্রিটিশ সরকার বিভিন্ন ভাবে দিনের পর দিন হয়রানি করতে থাকে অত্যাচারে সীমানা অতিক্রম করেছিল।গারোরা নিজেদের অধিকার আদায়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলতে আপ্রাণ চেষ্টা করে। অন্ত্র হাতে তুলার আগে গণতান্ত্রিক উপায়ে আন্দোলনে উপর জোর দেয় পা সোনারাম আর সাংমা। পা সোনারাম আর সাংমা গারোদের একত্রিত করে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়।সেই সুবাধে চারটি ইস্যু ভাগ করে কলকাতা ফোর্ট উইলিয়াম হাইকোর্টে মামলা করে।
মামলা গুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং জাতির জন্য এক বিশাল চ্যালেঞ্জ ছিল।সরকারের বিরুদ্বে মামলা পরিচালনার জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন ছিল,সেই টাকা বিভিন্ন গারো এলাকা থেকে সংগ্রহণ করা হতো।মামলা পরিচালনার জন্য ব্যারিস্টার কে প্রতিদিন ৩১০ টাকা করে দিতে হতো এবং মাসে ১৪০০ টাকা, ভাবা যায়!বর্তমানে এই টাকার মূল্য অনেক কম হলেও কিন্তুু সেই সময়ে হিসাব যদি ধরি লাখ লাখ টাকা কোটি পর্যন্ত খরচ হতে বাধ্য।সেই চারটি মামলা গুলো মূলত ছিল ১.নজরানা কেস ২.হাবরাঘাট পরগণা ৩.সংরক্ষিত বনাঞ্চল বাতিল ৪.বেগার প্রথা বাতিল।পা সোনারাম আর সাংমা গারো জাতির অধিকার আদায়ে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ব্রিটিশ সরকার অনেক বার তাকে এবং তার সহযোগীদের কারারুদ্ধ করে এবং জেল জরিমানাও করে।তবুও তিনি দমে যাননি,অধিকার আদায়ে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলে ব্রিটিশ সরকারের ভিট নাঁড়িয়ে দেয়।
পা সোনারাম আর সাংমাকে অনেক বার জেলে যেতো হয়েছিল, সেই সুবাদে অনেক বার জমানবন্দীতে সাক্ষ্য দিতে হয়েছিল।প্রাপ্ত তথ্য মতে জানা যায়,তিনি নাকি বলেছিলেন,"আমাকে গুলি করে মারতে পারেন,আমার আপত্তি নাই।কিন্তুু তার আগে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে আমার লাল রক্ত দিয়ে একথা লিখবেন, আপনাদের দাবী মেনে নিতে সরকার দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ"।তিনি আরো নাকি বলেছিলেন,"গুলি করে আমাকে ওই নদীতে ফেলে দিন কিন্তুু তার আগে কথা দিন,স্রোতের অনুকূলে আমার লাশ যতদূর ভেসে যাবে ঠিক ততদূর পর্যন্ত হবে গারোদের ভূ-সীমা"।এই উক্তি থেকেই আমরা বুঝতে পারি তিনি কতটা নিজের জাতিকে ভালোবাসতেন, নিজের জাতির জন্য মৃত্যুকে আলিঙ্গনে করতেও তার দ্বিধা ছিল না।তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রচন্ড রকম ভাবে জাতির জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে গেছেন।ঠিক কত বছর পরে মামলা রায় দেওয়া হয় তা জানা যায় না তবে কিন্তুু এই রায় ছিল ইতিহাসিক এবং গুরুত্বপূর্ণ।
এই রায়ে মামলার পুরো দাবি মেনে নেওয়া হয়নি আংশিক কিছু দাবি মেনে নিয়েছিল। সেই রায়ের ফলে গারোদের মধ্যে হতাশ বিরাজ করতে থাকে,শত চেষ্টা করেও যেহেতু সুফল পেল না সেহেতু আন্দোলন থেকে অনেক সহযোগী সরে যায়, একে একে সবাই সাংমার সঙ্গ ত্যাগ করতে থাকে, ফলে পা সোনারাম আর সাংমার জনপ্রিয়তা শূণ্যের কোঁঠায় চলে যায়। সব সত্ত্বেও কিছু সহযোগী সাংমার সাথে ছিল বিপদে আপদে কোন সময় ছেড়ে যেত না, সাংমার তারাই একমাত্র ভরসা ছিল।শেষ পর্যন্ত তবুও পা সোনারাম আর সাংমা দমে যাননি, পুরায় নতুন করে আন্দোলনে জোর দেয়। কিন্তুু তার শরীর আর এত ধগল সহ্য করতে পারেনি, এক পর্যায়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন,ক্রমশ অসুস্থতা বাড়তে থাকে, মৃত্যুর শেষ কিনারায় এসে নিজের স্ত্রী সন্তানদের মুখ না দেখে ক্ষত বিক্ষত স্বপ্ন নিয়ে নিজের কাজ অসমাপ্ত রেখে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন।তার মৃত্যুর সময় বয়স ছিল মাত্র ৪৮বছর, জানা যায়, তার মৃত্যুর তারিখ ২৭ আগস্ট ১৯১৬ সালে।এত অল্প সময়ে এত বিশাল বড় দায়িত্ব পালন করে গেছেন নিজের জাতির জন্য আকাশভরা স্বপ্ন নিয়ে আন্দোলন করেছিলেন।তিনি চেয়েছিলেন গারোদের জন্য একটুরো জায়গা যেখানে সমস্ত গারো এলাকা এক সাথে থাকবে,একটা স্বপ্নের গারো ল্যান্ড চেয়েছিলেন। খুব অল্প সময়ে আমরা এক মহানেতাকে হারালাম।তিনি যদি আরো কিছু দিন বেঁচে থাকতেন তাহলে পরিবেশ অন্যরকম হতে পারতো।
তিনিই প্রথম গণতান্ত্রিক উপায়ে আন্দোলন করা জন্য, সমস্ত গারো জাতিকে এক সাথে করেন।আন্দোলনের সফলতা ব্যর্থতা রয়েছে তবুও আমি ব্যক্তিগত ভাবে বলব, সেই আন্দোলন ছিল আমাদের জন্য এক মাইলস্টোন।তিনিই প্রথম গারো যিনি গারোদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রবর্তা এবং প্রথম গারো রাজনীতিবিদ। এই মহা নেতাকে প্রাণ ভরে স্মরণ করি,তার আদর্শকে আমাদের মনে রাখতে হবে। তার আদর্শ, প্রত্যাশা,বিশাল ভরা স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমাদের কাজ করতে হবে।আমরা হয়তো কেউ চাইব না পূর্বপুরুষদের অবদান মুছে যাক,আমাদের কর্তব্য হবে প্রজম্ম থেকে প্রজম্ম যে সকল গারো যোদ্ধা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছে তাদের ইতিহাস জানান দেওয়া এবং প্রত্যেক গারো সদস্যের অন্তরে যেন বাস করে পা সোনারাম আর সাংমা।
পা সোনারাম আর সাংমাকে জানাই, "লাল সালাম"।
No comments