চিঠি

জা'ডিল মৃ


উৎসর্গ-শোভন ম্রং,



ছবি:ইন্টারনেট
                         

চুপচাপ বিশাল এক জানলায় বসে আছি,হাতে বেনসন সিগারেট।খুব মজা করে পা নাড়াছি, আস্তে আস্তে সিগারেট টান দিয়ে চারিপাশের দৃশ্যগুলো উপভোগ করছি।ছোট কুঠিরে জানলায় বসা আমার সামনে মস্ত বড় এক বিশাল বিল,খুব সুন্দর জায়গা, সাথে মৃদুতর বাতাস,পাখির কিচিরমিচির,শাপলা ফুল, ব্যাঙের ডাক,ছোট মাছের খেলা, সবি যেন মন ছুঁয়ে যায়।আজকে আমার সাথে কেউ নেই,ইচ্ছে করেই কাউকে নিয়ে আসিনি,একাই যেন আনমনে চলে এলাম।সকাল থেকে বিষণ্ণতা গ্রাস করছিল,মন আনচান আনচান করছিল,কি যেন হয়েছে আমার, আমার নিজের কাছেই তা পরিষ্কার হচ্ছিল না,আমি কি করব?মাঝে মাঝে মনগুলো কেমন যেন মনমরা হয়ে যায়,কোন কিছু ভালো লাগে না,কি একটা বিষাদগ্রস্ত মন হয়ে যায়।সেই জন্য এই বিশাল জানলায় মাঝে মাঝে বসে থাকি,গাড়ির শব্দ নেই,মানুষজন নেই, গোলমাল নেই,লেখাপড়া নেই, স্বপ্ন নেই, চার দেওয়াল নেই,আমি এক মুক্ত পাখি এখানে প্রকৃতির সান্নিধ্যে আসা যায়,খুব ভালো লাগে যখন টুপটাপ বৃষ্টি পড়ে, আকাশে বিদুৎ চমকায়,আমি যখন বৃষ্টিতে ভিজি তখন সব কষ্ট মুছে যায়, বিষণ্ণতা মাটির সাথে মিশে যায়। এই জায়গাটা আমার সবচেয় প্রিয়।কোন কাজ না থাকলে এখানেই থাকে আমার অস্তিত্ব।

গোপন কথা বলি, সত্যি বলতে কি ইদানিং ছোট বড় সমবয়সি অনেক মেয়ের সাথেই খুব কথা হয়, সবাই কে কেমন যেন আমার আপনজন মনে হয়, আরো মনে হয় সবাই প্রতিটা মুহূর্ত সময়ে আমার প্রেমিকা।প্রেমিকা মনে হলেও কখনো শারীরিক চাহিদার কথা মনে হয়নি, কেমন যেন আত্নিক মানসিক সম্পর্ক।যাদের সাথে কথা বলতাম সবাইকে আমার ভালো লাগত কেন জানি একেক জন একেক রকমের; তাই বৈচিত্র্যপূর্ণ সময় উপভোগ করছিলাম।প্রেমিকা ভাবলেও জীবন সঙ্গীনি হিসাবে কাউ কে মনে ধরত না।জীবন সঙ্গীনি ভাবলেই তাদের মধ্যে অন্য রকম শূণ্যতা অনুভব করতাম।কি যেন নাই কি যেন নাই মনে হতো।কখনো কখনো প্রচন্ড প্রেমিকা পাওয়ার তাড়নায় ভুগতাম,আবার ভবঘুরেমি ভাব চেপে বসত,জানো তো ভবঘুরেমি ভাব থাকলে প্রেমিকা থাকতে নাই।আজ সকাল থেকেই কিছু সিদ্ধাতহীনতার মধ্য দিয়ে দিন পার করছিলাম।
   
একা থাকলে অতীতের কথা মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে,যতই বাদ দিতে চাও না কেন ঘুরে ফিরে আবার চলে আসে।একা থাকলে এই হচ্ছে ঝামেলা, পুরোনো অতীতের কথা  মনে পড়ে।এরুপ অজান্তেই আজকে বার বার  পুরানো কথা মনে পড়তে থাকে, তোমায় খুব প্রচন্ড রকম ভাবে মনে পরতে থাকে,জানো আজকে হঠাৎ করে তোমার সাথে কাটানো দৃশ্য চোখে ভাসতে লাগল।প্রথম যে দিন তোমায় দেখেছিলাম আকাশ ভরা পূর্ণিমার চাঁদ ছিল,তুমি চাঁদের কাছে কি যেন চাইছিলে,মজা করে তাঁরা গুনতে গুনতে আমার কাছে এসে ধাক্কা খেলে, নিজের জন্য লজ্জায় মুখ লাল করেছিলে,বার বার ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলে,ভাবলেই এখনো হাসি পাই।তখন কত সুন্দর ছিলে চাঁদের আলোর মত মুখ জ্বল জ্বল করে উঠতো।এখন জানি না দেখতে কেমন হয়েছো! সেদিন জোঁনাকি ছিল ভরপুর, জোঁনাকি ধরতে সাহায্য করেছিলাম বলে কত খুশি হয়েছিলে। ভাবতে পারো কত জোঁনাকি ধরে ছিলাম।এত কষ্ট করে ধরার পরে তুমি এক সাথে সব জোঁনাকি  ছেড়ে দিয়েছিলে,চারিদিকে আলোময় হয়ে গিয়েছিল  অনেক সুন্দর লাগছিল,জোঁনাকির আলোয় তোমাকে ভালো করে প্রথম দেখেছিলাম,এত সুন্দর লাগছিল মনে হয়েছিল তোমাকে ছাড়া জীবন অচল,আমার দেহ মন অবশ হয়ে গিয়েছিল।প্রথম দেখায় দুর্বলতা সৃষ্টি হয়েছিল, এখন যে নাই তা নয়।সেই সময় আমি কিছুটা বিরক্তবোধ হয়েছিলাম, এখন রাগ হয় এত কষ্ট করে জোঁনাকি  ধরে কোন লাভ হলো,সব তো ছেড়েই দিয়েছিলে।

কিছু দিন বাদে ফোনে একটা এসএমএস পেয়েছিলাম, আমি জানতাম না আসলে সেটা তুমি ছিলে!যখন জানতে পারি তখন থেকেই নিয়মিত যোগাযোগ হতো তোমার সাথে,তখন থেকে এক দিনও কথা না বলে থাকতে পারতে না। কত বার বলেছিলে তোমার সাথে আর কথা বলব না,পরে ঠিকি ফোন দিতে, এসএমএস দিতে, ফোন না ধরলে এসএমএস না দিলে রাগে আগুন হয়ে যেতে।তবুও কোন দিন মুখে বলনি"আমি তোমায় ভালোবাসি"আমি জানতাম আমাদের প্রেম কতটা গভীরে চলে গিয়েছিল।।মনে পড়ে,একদিন বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বুড়িগঙ্গা নদীতে গিয়েছিলাম,নৌকাতে উঠেই ময়লা পানি দিয়ে আমায় ভিজিয়ে দিয়েছিলে না করা সত্ত্বেও তুমি নাছোড়বান্দার মত বিষাক্ত পানি খেলেছিলে।অবশ্য খারাপ লাগছিল না কি রকম একটা রোমান্টিক ভাব পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল, সেই পরিবেশটা নষ্ট হোক সেটা চাইছিলাম না।এর ফলাফল মারাত্মক হলো,সারা শরীরে আমার চুলকানি শুরু হয়েছিল, ডাক্তার পরামর্শ নিয়ে ঔষধ খেতে হয়েছিল। তুমি হাসতে হাসতে পেট ব্যাথা করেছিল,চুলকানি দেখে খুব মজা পেয়েছিল।সেদিন প্রথম প্রাণ ভরে তোমার হাসি দেখেছিলাম,হাসি কত সুন্দর ছিল।আমি বিস্ময় নিয়ে তোমার দিকে তাকিয়ে ছিলাম।


তোমার আবদারগুলো কেমন যেন অদ্ভুত রকমের ছিল,কড়া রৌদ্রদগ্ধ সময়ে হাত ধরে হাঁটতে চাইতে শতবার বলার পরেও রিস্রা নিতে না। বাংলা সিনেমা দেখে কিযে মজা পেতে আমার সেটা কোন দিন মগজে ছিল না, জোর করে আমাকে নিয়ে যেতে, দেখতে হতো।অবশ্য মাঝে মাঝে ভালো সিনেমা বের হতো, ভাবতাম তা যদি সব সময় বের হতো বড় জোর বাঁচা যেত। কেন জানি জঙ্গল খুব ভালোবাসতো,সবসময় জঙ্গলে নিয়ে যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করতো বাধ্য হয়ে ভয়ে ভয়ে মাঝে মাঝে নিয়ে যেতাম, কি যে পেত জঙ্গলে সেটা আমার ধারণার বাইরে ছিল,জঙ্গলে গেলে আমার আর প্রয়োজন হতো বলে মনে পড়ে  না। কতবার বলেছি ভালো রেস্টুরেন্টে গিয়ে একসাথে দুপুরের খাবার খাব,সবকিছু  ঠিক করেও রেখেছিলাম,কিন্তুু সে তো রেস্টুরেন্টে খাবে না একটা টং দোকানে দাঁড়িয়ে চা খাবে সাথে বিস্কুট তার পর একটা কলা। মাঝে মাঝে নিজেকে পাগল মনে হতো,মনে হতো তোমার সাথে আমিও পাগলামি করছি।আমার কাছে অস্বাভাবিক বিষয় গুলো তার কাছে ছিল স্বাভাবিক। মাঝে মধ্যে এমন কান্ড করে ফেলতো নিজেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যেতাম।সেদিন তো আমাকে না বলেই শুকরের বাচ্চা এনে বলেছিলে আমি যেন তাকে নিজের শোবার ঘরে রাখি যত্ন করে রাখি যেন কষ্ট না দেয় তাহলে সেও কষ্ট পাবে। তার কান্ড দেখে মাঝে মধ্যে পাগল হওয়ার উপক্রম হতো।

তার পরে হঠাৎ করে তোমার ফোন বন্ধ,শত চেষ্টা করেও তোমার সাথে যোগাযোগে আর হয়নি।আকস্মিক তোমার চলে যাওয়া আমায় খুব ব্যথিত করেছিল।কোনদিন ভাবতে পারেনি মৃত্যু আগে তোমাকে হারাতে হবে,নিজের মনকে বোঝানো বড় দায় হয়ে গিয়েছিল। কোনকিছু না বলে কোথায় যে চলে গিয়েছিলে, আমি শত চেষ্টা করেও উদ্ধার করতে পারেনি। প্রথমে তোমার আজব কান্ড, পাগলি খুব বিরক্ত লাগতো।তোমার যাওয়ার পর থেকে খুব শূণ্যতা অনুভব করতে লাগলাম।মনের ভেতর ঝড় বইতে শুরু করেছিল, আত্নহত্যার পথ চিন্তা করেছিলাম।এই ভেবে আর পা বাড়াইনি, যদি কোনদিন আবার দেখা হয়।একটি বার তোমার মুখ দেখার জন্য ঝটপট করছিল,আমি খুব শুকিয়ে গিয়েছিলাম, নিজের শরীর দেখে নিজেই চমকে উঠেছিলাম এত চিকন হয়ে গিয়েছিলাম, যাকে বলে শুকনো কাঠি।ভাবতে পারো আমি কেমন পাগলের মত হয়ে গিয়েছিলাম।কোন কিছুতে মন বসতো না, কত নিঘুম রাত কেটেছে কে জানে?তুমি ছাড়া আমি আবার আগের মত একা হয়ে গেলাম,একা একাই জোঁনাকি ধরতাম,বুড়িগঙ্গা যেতাম চা খেতাম সাথে সিগারেট।

একা ভাব কাটিয়ে উঠতে বেশ সময় লেগেছিল;আস্তে আস্তে বন্ধু বাড়াতে লাগলাম, যখনি তোমার কথা প্রচন্ড রকম ভাবে মনে পড়তো,আমার সাথে সঙ্গ দিত হুমায়ুন আজাদ,হুমাহুয়ন আহমেদ,মুহম্মদ  জাফর ইকবাল,আহমদ ছফা, তসলিমা নাসরিন,মিঠুন রাকসাম,পরাগ রিছিল,আনু মুহাম্মদ, মহাশ্বেতা দেবী,সুমনা চিসিম আরো অনেকে এমনি ভাবে বন্ধুর সংখ্যা বেশি বেড়ে গিয়েছিল। নিজেকে তখন একা লাগত না,দিনগুলো বেশ ভালোই কেটে যাচ্ছিল।নিজেকে খুব ব্যস্ত রাখতাম পাছে তোমার কথা যদি মনে পড়ে।মনে পড়া মানে কষ্টে জর্জরিত হওয়া,সহজে ভুলতে না পারা, সেটা নিয়ে খুব ভয়ে ছিলাম।অবিশ্বাস ভাবে সকালে উঠেই তোমার চিঠি পেলাম,আমার কল্পনার বাইরে ছিল ফোন না দিয়ে কেন চিঠি দিলে।এত দিন পর মনে পড়লো?নানা রকম প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল।চিঠি এই রকম ছিল...

প্রিয় শোভন,

আমি চেয়েছিলাম তুমি আমাকে তন্নতন্ন করে খুঁজো,তোমার সাক্ষাৎ খুব বেশি প্রয়োজন ছিল আমার  জন্য, দিনের পর দিন দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেছিলাম।শেষ পর্যন্ত চিঠি লিখতে বাধ্য হলাম।তোমার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে কেন আমি চিঠি লিখলাম।তার বহুবিধ কারণ আছে,আমি সবকিছু এখানে বলতে পারব না শুধু জেনে রাখ ফোনে তোমার সাথে কথা বলতে পারতাম না আমার চোখে কান্না এসে পড়তো,কাথাগুলো সব কিছু এলোমেলো হয়ে যেতো।নিজের আবেগ সহ্য করার মত বর্তমান অবস্থা আমার নেই।জানো তো, দীর্ঘ সময় তোমার সাথে যোগাযোগ না থাকাটা আমার কাছে অনেক পীড়াদায়ক। জানি,তোমার মনে অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাবে,চিঠিতে  সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।সেদিন হঠাৎ করে মা অসুস্থ হয়ে পড়ে খুব তোড়জোড় করে উন্নত চিকিৎসার জন্য মেঘালয় যেতে হয়।মার সাথে সবসময় থাকতে হয় বিধায়, নতুন সিম কিনতে পারেনি, বলতে পারো সময় পায়নি।আমি জানি তোমাকে বলে আসাটা দরকার ছিলো,কিন্তুু সেই পরিস্থিতি ছিল না।রিপোর্টে মার ক্যানসার ধরা পড়ে,ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ার আগে অপারেশন করতে হলো,বাবা থাকতে না পারাই মার সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আমাকে থাকতে হলো।আমি চেয়েছিলাম আমার আত্নীয় কারো সাথে যোগাযোগ করে তুমি আসো,আমি খুব শূণ্যতা অনুভব করেছি।আমি জানি, আমার উপর অনেক অভিমান করেছ, অনেক রাগ জমা হয়ে আছে,বাবু কি করব বলো?আমার তখন সেই পরিবেশ ছিল না। সবকিছুর জন্য সরি চাইছি,প্লিজ চিঠি পাওয়ার পর রাগ করো না। আমি খুব তাড়াতাড়ি দেশে ফিরে আসছি, আগামী বুধবার সন্ধ্যা ৭টা ঢাকা পৌঁছাব। প্রথমে আমি চাই তুমি আমাদের নিতে আসবে।আমি মার কাছে তোমার সব কথা বলেছি, মার কোন আপত্তি নেই,মা তোমাকে দেখতে চেয়েছেন।বাবু আমি জানি তুমি আসবে, তোমাকে কখনো দিন ভালোবাসি কথাটা বলতে পারেনি। বাবু সত্যি, তোমায় অনেক ভালোবাসি।
আমার বিশ্বাস তুমি আসবে,আমাকে নিরাশ করো না।আর হা,আমার শুকরে বাচ্চাটা কে নিয়া আসবা।

ইতি,
তোমার ভালোবাসা
রিমমিট



কালকে বুধবার, আজকে সারাদিন মাথা ঝিমঝিম ধরে আছে।এখন প্রায় সন্ধে হয়ে আসছে আমার জীবনের কঠিনতম রাত হতে চলছে, আমি জানি না কি করব।একা থাকতে থাকতে বেশ অভ্যস্ত হয়েগেছি,এখন আর তেমন খারাপ লাগে না,দীর্ঘ তোমার সান্নিধ্য না থাকার ফলে তেমন একটা প্রয়োজনবোধ করছি না।কিন্তুু তোমার ভালোবাসা আমায় পাগল করে ,তবে আমার কি যাওয়া উচিত ? নাকি একাই থাকব?অন্যদিকে একরাশ প্রশ্ন মাথায়।

মনে মনে বার বার ভাবছি
পরামর্শক  দরকার...অতি প্রয়োজন।




1 comment:

Theme images by saw. Powered by Blogger.