এক টুকরো জমির জন্য!।। জাডিল মৃ।।

এক টুকরো জমির জন্য!

জাডিল মৃ(Jadil Mri)




জাডিল মৃ
 
ছবি-জ্যাক হাজং


(আ'বিমা ও আ'ফাল অঞ্চলের বসবাসরত গারো আদিবাসীদের অবস্থান নিরিখে লেখা)

১.
সারা বিশ্বের হিসাব নিকাশ এক নিমিষেই উল্টপাল্ট হয়েগেল;একটি মাত্র ভাইরাসের কারণে।যাকে বলে 'করোনাভাইরাস'।সে-ই জন্য আবার নতুন করে পৃথিবীকে সাজাতে হবে।পুরানো অভ্যাস,যা কিছুই খারাপের দিকে ছিল তা সবকিছুই ত্যাগ করে ভালো কিছুর জন্য তৈরি হতে হবে। যাতে পৃথিবীতে বিরাজমান এমন সবকিছুই সকলের জন্যই মঙ্গলজনক হয়।এই সংকটপূর্ণ মুহূর্তে গারো আদিবাসীদের অবস্থা দিন কে দিন আরো গভীর থেকে গভীরে সংকটময় হয়ে উঠেছে।যা আমরা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।এই যাবৎকালে শহরমূখী বা রাজধানী ঢাকাতে যাওয়া গারোদের সর্বনিম্নতম অনুপাতের সংখ্যা দেখছি।বরং আগে যেমন অনেক গারো ঢাকাতে যেতো;যেন নতুন করে জীবন যাপনে অভ্যস্ত হতে পারে।কিন্তু এখন পরিস্তিতির কারণে আবার অনেকেই ঢাকা থেকে গ্রামে ফিরছে,নতুন করে গ্রামের সাথে অভ্যস্ততা সখ্যতা তৈরি করতে চেষ্টা করছে।যা নেহাতি কম নই।আবার অনেক পরিবার আছে, যাদের গ্রামের যাওয়ার সুযোগ নেই।বেঁচে থাকা কিংবা মরে যাওয়া, তাদের জীবন শহরেই।কারণ গ্রামে এক টুকরো জমি পর্যন্ত  অবশিষ্ট নেই।তাহলে তাদের যাওয়ার জায়গা কোথায়??

‌"শুধু মাত্র এক টুকরো জমির জন্য।"


২.
অনেকগুলো সমস্যার মধ্যে আজকে কয়েকটা সমস্যার কথা বলতে চাই।এই করোনাভাইরাসের কারণে যা প্রচন্ড রকম সংকটজনক অবস্থায় দেখছি।ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে কমবেশি সবাই বাড়িতে আছে। ফলে, বাড়ির জনসংখ্যা গতানুগতিক বৃদ্ধি পেয়েছে।সবার পরিবারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে তো বটে, তবে ইনকাম বৃদ্ধি পাইনি।যে বিষয়টা সবেচেয়ে বেশি নাড়া দিচ্ছে সেটা হলো,আ'বিমা অঞ্চলের গারোদের কমবেশি সবার জমি আছে(বাড়ি ভিটা বাদে)।কিন্তুু এখন নিজেদের জন্য শাক-সবজি লাগাবে সেটার পর্যন্ত জায়গা নেই।কেন??এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছি অনেকদিন।তার কারণ সবার জমি লিজ দেওয়া!এখন এই পরিস্তিতিতে নিজের জমিতে নিজেদের দিনমজুর/কামলা বা কাজকর্ম করতে হচ্ছে।আরেকটা বিষয় খেয়াল করেছি আমাদের গারোদের ব্যবসা কিংবা চাষবাসে অনীহা সবেচেয়ে বেশি।যাদের জমিজমা আছে তারা লিজ দিচ্ছে/দিয়েছে। যাদের নেহাতি কম তাঁরাও লিজ দিচ্ছে।আবার কিছুলোক পেয়েছি যাদের জমিজমা কম তবে চাষবাসে মনোযোগী বেশি তবে জমি কম হওয়ার সুবাধে বেশিদূর অগ্রসর হতে পারছে না।

‌শুধু মাত্র এক টুকরো জমির জন্য...



৩.
এই সংকটপূর্ণ মুহূর্তে শহর ছেড়ে মানুষ গ্রামে আসছে।যা আমি ইতিবাচক হিসাবে দেখছি।তবে আরো বেশি খুশি হতাম যদি নিজেদের জমিতে নিজেরাই চাষবাস করতো।আমরা চাকরি বা অনেক টাকা ইনকামের আশায় শহরে যাই।অথচ দিনশেষে কত টাকা জমাতে পারি?কিন্তুু দেখ,যাদের কাছে আমরা জমি লিজ দিই তাঁদের হাতে লাখ লাখ টাকা থাকে।কেন থাকে?আমরা কেন পারি না!!!অধৈর্য? পুঁজির অভাব?জমির অভাব?ক্ষতির ভয়? নাকি অন্য কিছু..আমি জানি না।

‌শুধু মাত্র এক টুকরো জমির জন্য..



৪.
জীবনে প্রচুর অভিজ্ঞতা হচ্ছে,এই তো ক'দিন আগে শুনলাম যে, এতগুলো জমি বেচে গ্রামে বিন্ডিং বাড়ি করছে!কথাটি শুনে অনেক হাসতে ইচ্ছে হলো আবার প্রচন্ড রাগ হলো।আচ্ছা!কি দরকার ছিলো বলো তো?যদি শহরে কোথাও বাড়ি বানিয়ে ভাড়া দিতো কিংবা গ্রামেও বাড়ি থেকে ইনকাম হতো তাহলে একটা কথা ছিল।এই বাড়ির জন্য এতগুলো জমি বেচে দিলো ভবিষ্যতে উনার ছেলেমেয়েরা কি করে খাবে!ভাবতেই কত ধরনের চিন্তা মাথায় খেলছিল।খুব সাংঘাতিক ভেবে ফেলেছিলাম, উনি যখন মৃত্যুবরণ করবেন "এক টুকরো জমি জুটবে তো"!!এত জমিজমা বেচে লিজ দিয়ে বাড়ি বানাচ্ছে!আপনারাই বলেন,তাদের কে কি বলা উচিত?



৫.
আমার পরিচিত কিছু ব্যবসায়ি আছে যারা দীর্ঘদিন যাবৎ ঢাকায়  কাজ করেছে।এখন গ্রামে এসে ছোটবড় ব্যবসার সাথে জড়িত।তাঁদের কথা শুনলে মনে খুব অনুপ্রেরণা পাই।তাঁরা বলে," শহরে কাজ করতে যাওয়ার মতো দ্বিতীয় ভুল আরো কোন কিছু নেই।এত বছর চাকরি করলাম, এত টাকা ইনকাম করলাম।এত বছর পরে দেখলাম হাতে পুঁজি নাই,জমানো টাকা নাই।"কিন্তুু দেখ তাঁরা দুই/তিন বছর ব্যবসা করে ১৫/২০ বছরে যা ইনকামের পুঁজি করেছিল।এখন তা ডাবল  হাতে টাকা আছে।তারা আরো বলে," আগে যদি ব্যবসার সাথে জড়িত থাকতাম এতগুলো বছর ব্যয় করতে হতো না।এখন গ্রামে খুব সুখেই আছি।বিশুদ্ধ বাতাস শাক-সবজি, নিজেদের জমিতে
কলা,আনারস,হলুদ,লাগিয়েছি, ধান লাগিয়েছি দিব্যি সংসার ভালোই চলছে।"

‌শুধু মাত্র এক টুকরো জমির জন্য..



৬.
আদিবাসীদের কথাই যদি ধরি তাহলে বলবো যে কোন আদিবাসী জমি ছাড়া বাঁচতে পারে না।সেটা গারো হোক বা অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী। কেন না গারো আদিবাসীদের সাথে বনভূমি, জমি ওতপ্রোতভাবে জড়িত যার ফলে যেদিন গারো আদিবাসীর হাতে জমি থাকবে না;সেদিন থেকে জাতির অস্তিত্ব বিলীন হতে থাকবে।সেটা আমরা এখনি এই মুহূর্তে প্রত্যক্ষ করতে পারি।গ্রামের পর গ্রাম নিচিহ্ন হয়ে যাচ্ছে জমি হারানোর ফলে।এখন যা অবশিষ্ট আছে তাও হারানোর পথে।এক টুকরো জমিই জাতির অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারে।



৭.সেদিন মামার কথা খুব কানে লেগে আছে।তিনি বলছিলেন,"গারো ছেলেমেয়েদের কথা কি আর বলবো!!জাডিল কিছু মনে করো না,তোমাদের সামনেই বলতে হচ্ছে।যারা বিত্তশালী পরিবারে জন্মগ্রহণ করে কিংবা যারা সহজেই উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি লাভ করে তারা জমির মরর্ম, কষ্টের মরর্ম কি বুঝবে?নিজের সৎ ইনকামের টাকায় যদি সম্পত্তি করতো তাহলে হাড়ে হাড়ে টের পেতো।এত সহজেই সম্পত্তি বা জমি বিক্রি করে ঘর বিন্ডিং করা কিংবা হোন্ডা কিনা বা নেশা করা যা কিছুই করুক।তখন এইসবের মূল্য বুঝতো।"বুঝছো জাডিল,"বসে বসে খেলে রাজার ভান্ডার পর্যন্ত শেষ হয়ে যাই"।



৮.

তবে আমিও খেয়াল করেছি।বেশিভাগ ক্ষেত্রে পুরুষদের জন্য সম্পত্তি বিক্রি করতে হয়। কেউ মানুক বা না মানুক,আমি বলবো পুরুষের চাইতে নারীরা বেশি পরিশ্রম করে।সেই তুলোনায় মূল্য বা মজুরি কম।আবার যেটুকুই সম্পত্তি পাই না কেন, কমবেশি সবাই একটু একটু করে বেচে দেয়।নিজ থেকে প্রচুর সম্পত্তি করেছে বা করতে পেরেছে সেটা নেহাতি কম(সম্পত্তি বলতে-জমিজমা)।



৮.এক টুকরো জমি জন্য কত হাহাকার, কতজন কান্নায় নিমজ্জিত হচ্ছে।জমি না থাকলে সাথে সাথে বিলীন হয়ে যাবে আদিবাসীদের গ্রামের পর গ্রাম।অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে "গারো" নামক একটি জাতিগোষ্ঠীর বসবাস,
এক টুকরো জমির জন্য!এই আ'বিমা কিংবা আ'ফাল অঞ্চল গারোদের ছিল। যুগ যুগ ধরে তারাই বসবাস করতো/বসবাস করে আসছে।হয়তো সেটাও মুছে যাবে জানি।কারণ ইতিহাস তারাই রচনা করে যারা জয়ী, যারা অধিক ক্ষমতার অধিকারী।

এক টুকরো জমি জন্য কত কিছুই তো হয়!আবার এক টুকরো জমি ছাড়া গারো আদিবাসীরা হবে অস্তিত্বহীন!






No comments

Theme images by saw. Powered by Blogger.