দান্তাল হাতি ও শজারু।।গারো লোককাহিনী।। ভাষান্তর-দেবাশীষ ইম্মানূয়েল রেমা।।
দান্তাল হাতি ও শজারু
মূল: দেওয়ানসিং এস রংমুথু ভাষান্তর: দেবাশীষ ইম্মানূয়েল রেমা।
উদীয়মান তরুণ কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক।
একদিন এক বিশাল হাতি স্বচ্ছ এক নদীতে চনমনে জল পান করছে। জল হঠাৎ বেশ ঘোলা হয়ে যায়। দান্তাল হাতি এতে খুব রেগে গেল। নিজেকে এই বিশ্বচরাচরের সবথেকে বড় এবং সবথেকে শক্তিশালী জ্ঞান করত। বিশাল দান্তাল হাতি বুঝে উঠতে পারল না তার জলপানের স্থান নোংরা করার সাহস কার হয়। অবশেষে খেপা প্রাণিটা এক শজারুকে তার গর্তে ঢুকতে দেখল। শজারু সবে নদীস্নান সেরে নিয়েছে। দান্তাল হাতি কাছে এগিয়ে গিয়ে উচ্চৈস্বরে ডাক ছাড়লো,
“তুমিই কি ঢালের দিকে জলপানের সময় জল ঘোলা করছিলে?”
শজারু বাঁকা চোখে তাকালে দান্তাল হাতি গর্জন করে উঠে,
“ক্ষুদে প্রাণি, আমার পান করা জল নোংরা করার স্পর্ধা তোমার কি করে হয়? তুমি জান না আমিই হলাম সব প্রাণির থেকে বড়?”
শজারু খেপাটে পশুকে অবজ্ঞাভরে আড়চোখে চেয়ে দেখে শান্তভাবে বলে,
“আমি যে জলের একমাত্র কর্তা, সেই জল পান করতে আসার মত স্পর্ধা তোমার কি করে হয়? আমি যে স্থানের একচ্ছত্র মালিক সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার মত সাহস তোমার কি করে হয়? তুমি কি জান না চারিদিকের সমস্ত ভূতল এবং ভূ-গর্ভস্থ পাতালদেশের আমিই রাজা? বেরিয়ে যাও নতুবা আমি তোমাকে মাটিতে জ্যান্ত পুঁতে ফেলব।“
হাতি ছোট প্রাণিটার দিকে বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে থাকে যে কিনা এমন ঔদ্ধত্যভঙ্গিতে কথা বলছে। সে বলল, “মানে? বাকী সব প্রাণি আমাকে প্রাণিদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে স্বীকার করে আর তুমি কিনা এখন বলছ তুমিই সবার বড়? আমার কাছে কি আর সবার কাছে প্রমাণ করে দেখাও তুমি আসলেই আমার থেকেও অনেক বেশি বড়।“
শজারু রেগে গিয়েও চতুর উত্তর দিল, “তোমার এতো বড় সাহস তুমি সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সব প্রাণি থেকে সেরা জীবের সাথে এভাবে কথা বল? আমার সাথে তোমার এসব তর্ক-বিতর্ক চলবে না। কেন, তোমার এত বড় শরীরটা আমার পায়ের সব থেকে ছোট আঙুলের সমান না। শুধু তোমার আর আমার শরীরের চুলের ফারাক দেখ। তাহলেই দেখতে পাবে।“
এই কথা বলার সাথে সাথে ঔদ্ধত্য শজারু তার গর্তের প্রবেশপথে বুক চিঁতিয়ে উঠে দাঁড়াল। অনুপ্রবেশকারী কেবল তার শরীরের সামনের অংশটিই দেখতে পেল আর শরীরের বাকী অংশ থাকল তার গর্তের ভিতরে। প্রতিপক্ষের ঔদ্ধত্য বক্তব্যে দাঁতালো হাতি শজারুর খাড়া কাঁটার একটি তুলে নিয়ে চমকে যায় দেখে যে শজারু তার শরীরের লোমকে কীভাবেই না কাজের কাজ করে তুলেছে। যা দেখলো তা নিয়ে সে যখন ঘোর চিন্তায় মগ্ন তখন ছোট প্রাণিটা অসন্তুষ্ট হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “বোকা, যে শরীর মাটির নিচে রয়ে গেছে আর যার এত বড়, শক্ত চুল সেই শরীর কি তোমার ঘৃণ্য মরা লাশ থেকেও অবশ্য বড় নয়?”
তারপর এক মহাঝঙ্কারে ইতি টানল, “কেটে পড়। নইলে খুব শীঘ্রই মারা পড়বে। এখানে এসে এভাবে আমাকে অপমান করার কোনও অধিকার তোমার নেই।“
দুজনের চুল তুলনা করে সরল হাতি নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করে ফেলল যে শজারু তার থেকেও অনেক বড়। আর আতঙ্কে যত দ্রুত সম্ভব সটকে পড়ল।
এদিকে ছুঁচো (গন্ধমূষিক) পরিবারের পিতৃতান্ত্রিক প্রধান গিপি জঙ্গাপা ওয়াচিংপা১ নীরবে পুরো বিতর্ক শুনছিল। বাস্তবে এই দুই প্রাণিই তার পরিচিত ছিল। তাই, তুচ্ছ শজারুর ভয়ে রাজোচিত হাতিকে পালাতে দেখে নিজেকে আর দমিয়ে রাখতে পারল না। হেসে উঠল, সে যে কি হাসি। হাসি আর হাসি। অনেকদিন ধরে একটানা হেসেই গেল, হাসি যে আর থামে না। অনবরত হাসতে হাসতে চোখ হয়ে গেল কুঞ্চিত। দীর্ঘ সময় নিয়ে বিরতিহীন এমন কঠিন হাসিই হাসলো যে দীর্ঘ সময়ের জন্য নিজের মুখ বন্ধ করতে এবং চোখ খুলতেই ভুলে যায়। বুকে স্পন্দন হতে হতে হাঁপাতে থাকল, ঠোঁট ফেটে গেল, তার পুরো শরীরটা দুলছে আর হাসিতে ফেটে পড়ছে।
ফলে, অনেক অনেক দিন আগে শজারু সম্বন্ধে দান্তাল হাতির ভুল ধারণা দেখে, তাদের পিতৃতান্ত্রিক প্রধানের অত্যধিক জবর হাসির কারণেই ছুঁচোদের (গন্ধমূষিক) ঠোঁটের উপরিভাগ আজও অব্দি খোলাই রয়েছে। আর চোখ রয়ে গেল ক্ষুদ্রাকৃতির হয়ে এবং অংশত বন্ধ।
মিনসেং মারাক মাংসাং কর্তৃক কথিত
সেনাবার গ্রামে (কামরূপ-ক্ষেত্রি), কামরূপ জেলা
পাদটীকাঃ
গিপি জঙ্গাপা ওয়াচিংপা: আক্ষরিক অর্থে, গিপি, জঙ্গা (গর্তবাসী)-এর পিতা এবং ওয়াচিং (ধারালো চোখা ক্যানিন দাঁতঅলা)-এর পিতা।
No comments