সাধু সঙ্গের কিছু শিক্ষা
সাধু সঙ্গের কিছু শিক্ষা
পরাগ রিছিল
কবি ও লেখক
সুজন ন্যাংটার বয়স ৪৯ বছর। ৩৬ বছর যাবৎ চলছে তাঁর সাধু জীবন যাপন। ১০ বছর বয়সে তিনি "পাগল" হয়ে যান। সেই দশ বছর তিনি ছিলেন শেকল পড়া অবস্থায়। গুরু একটি বড় দা হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন, আর একটি লাল গামছা তিন টুকরা করে এক টুকরা দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলেন লজ্জাস্থান, এক টুকরা বেঁধে দিয়েছিলেন মাথায় অপর টুকরাটি কোমরে, সেই থেকে তিনি সুজন ন্যাংটা।
সাধু হবার পর সেই দা জমা দিয়ে আসেন গুরুর চরণে। সুজন ন্যাংটার গুরু হচ্ছেন দোহাই ন্যাংটা। সেই সময়ে কমিউনিটির ক্ষতি করতে চাইলে শরীরে বল বেড়ে যেত, ভর করতো যেনবা অসুরের শক্তি। তিন- চারজনও ধরে রাখতে পারত না তাকে। সে সময়ে কারো দ্বারা সাধুদের কোন ক্ষতি হতে দেননি।
সুজন ন্যাংটা বংশানুক্রমেই সাধু হয়েছেন। সুজন ন্যাংটার বাবা দেব নারয়ণ সাধু, দেব নারায়ণের বাবাও ছিলেন সাধু। সুজন ন্যাংটা পায়ে কোনো স্যান্ডেল-জুতা পড়েন না গুরুর সম্মানে। কারণ গুরুও পড়তেন না। খাবারের থালা, থাকার কম্বল, পাঁচটি গামছা, নিত্য ব্যবহার্য জিনিস সবসময়ই থাকে নিজের সাথে। তাই যেখানে খুশি সেখানেই রাত্রি যাপন করতে পারেন, হোক রাস্তার ধার, বাসস্ট্যান্ড বা কোনো মাজার।
কোন জাতপাতে বিশ্বাস করেন না। বলেন, মানুষের কর্মফলে আর হিংসায় বিভিন্ন জাতের সৃষ্টি। যেমন কেউ যদি জুতা সেলাইয়ের কাজ করে, আমরা তাকে বলছি 'মুচি', কেউ যদি ড্রেন পরিস্কারের কাজ করে তাকে বলছি ' 'মেথর' এমন না।ককরণ ককরছি কর্মগুণের ওপর। এইসব বিভক্তি করছি আমরা নিজেরা, মানুষেরা। পৃথিবীতে জাতি মূলতঃ দুইটাই, একটা নারী জাতি, একটা পুরুষ জাতি। স্মরণ করিয়ে দেন, লালন কি জাত? জাত সম্পর্কিত লালনের কথাগুলো; জাতের ভেদাভেদ করবেন আপনি ক্যামনে?
বাড়িতে নিজেদের যে মা-বোন অাছে, রাস্তা দিয়ে যারা চলাচল করছেন, তাঁদেরকেেও দেখতে হবে একই দৃষ্টিতে, দৃষ্টি দিয়েও পাপ করা যাবে না।
মানেন- ' মিথ্যা বলাটাই পাপ'। অকপটে স্বীকার করলেন, সামনে পেলে ' সিদ্ধি' সেবন করেন। তবে সমসময় না, পোটলায় পান- সুপারির খিলি রাখেন সুজন ন্যাংটা।
৪৯ বছরের জীবনে তাঁর অনেক অভিজ্ঞতা। খুলনায় থাকার সময় খ্রিস্টান মিশনে যেতেন, অালোচনা করতেন ফাদারদের সাথে, ভাল লাগত। বাচ্চাছেলেমেয়ে বা খুব বয়স্কদের সাধারণত 'বাপ' 'আব্বা' বলে সম্বোধন করেন।
দয়াল, গুরু, কোরান, হাদিস, জল, মন্দির, মসজিদ এই সমস্ত শব্দ কথায় ব্যবহার করে যখন একাকার করে ফেলেন তখন ধর্মীয় পরিচয় খোঁজা সত্যি কঠিন হয়ে যায়! নিজের মনের ভেতর প্রশ্ন উঁকি মেলে, সত্যি কি উনি মুসলমান নাকি হিন্দু? অনেক ধর্মের বিষয়েই অগাধ জ্ঞান রাখেন। ' এইসব বিষয়ে বললে তো তারা বুঝবে না' ' তারা জানে কিন্তু মানে না' আমি কিতাব অনুসারেই কথা বলব। জানাটাই বড় কথা না, মানাটাই বড় কথা। যে কোন বিষয়ে অালোচনা, বাহাসে যেতে প্রস্তুত থাকেন, মা ফাতেমার দুই সন্তান হাসান- হুসেনকে তলোয়ারের নিচে ফেলতে চেয়েছিল কারা? বলেন মাতাল রাজ্জাকের গানের কথাও- আমি মদ খেয়েছি/ মাতাল হয়েছি/ সরে দাঁড়া সব.. ...। জীবৎকালে দেখা পাওয়া হুমায়ন সাধুকে ' বড় সাধু' বলে মানেন। হুমায়ন সাধুকে স্মরণ করতে গিয়ে হাতের লোম দাঁড়িয়ে গেল!
পৃথিবীর বড় মাওলানা মাঃ সুলতান কমরুদ্দীন রুমী নেত্রকোণার মদনে আপনাদেরই গারোর কাছে সমস্ত কিছু দিয়েছিলেন। আমি প্রশ্ন করি, মদন যে একজন গারো ছিলেন, তা আপনারা সবাই জানেন? - সবাই জানে না, আমরা অনেকে জানি।
মদনে সুজন ন্যাংটা এক সময় অাগুন ধ্বনি করতেন, আগুন দিয়ে লাঠি খেলা খেলতেন। প্রশাসনের কড়াকড়িতে 'অাগুন লাঠিখেলা' এখন বন্ধ হয়ে গেছে।
সুজন ন্যাংটারা ৪, ভাই, ১ বোন, সেই একমাত্র বোনের সাথে দেখা করলেন এবার ১০ বছর পর। আজমীরে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশের সাধুরা মিলিত হন। এ বছর গেলে সুজন ন্যাংটার যাওয়া পড়বে ২০ বার। এ যেন পৃথিবীতে " জান্নাতুল ফেরদৌস"।
মন্দির- মসজিদ পৃথিবীর পবিত্র স্থান হচ্ছে মা। সন্তান ভাল অাছে, নাকি মন্দ অাছে, সবার অাগে বুঝতে পারেন মা।
" মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি"। সাঁই মানে স্রষ্টা। লালন যখন সাঁই হয়ে নাই হয়ে যান, তখন লালনকেইবা খুঁজে পাব কোথায়?
" কেমনে বুঝাব তোমায়/ লালন আমার কে?/ অামি লালন নই রে ভবে/ দেখ না জ্ঞান চক্ষে"।
পরাগ রিছিল
কবি ও লেখক
ছবি:পরাগ দা |
সুজন ন্যাংটার বয়স ৪৯ বছর। ৩৬ বছর যাবৎ চলছে তাঁর সাধু জীবন যাপন। ১০ বছর বয়সে তিনি "পাগল" হয়ে যান। সেই দশ বছর তিনি ছিলেন শেকল পড়া অবস্থায়। গুরু একটি বড় দা হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন, আর একটি লাল গামছা তিন টুকরা করে এক টুকরা দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলেন লজ্জাস্থান, এক টুকরা বেঁধে দিয়েছিলেন মাথায় অপর টুকরাটি কোমরে, সেই থেকে তিনি সুজন ন্যাংটা।
সাধু হবার পর সেই দা জমা দিয়ে আসেন গুরুর চরণে। সুজন ন্যাংটার গুরু হচ্ছেন দোহাই ন্যাংটা। সেই সময়ে কমিউনিটির ক্ষতি করতে চাইলে শরীরে বল বেড়ে যেত, ভর করতো যেনবা অসুরের শক্তি। তিন- চারজনও ধরে রাখতে পারত না তাকে। সে সময়ে কারো দ্বারা সাধুদের কোন ক্ষতি হতে দেননি।
সুজন ন্যাংটা বংশানুক্রমেই সাধু হয়েছেন। সুজন ন্যাংটার বাবা দেব নারয়ণ সাধু, দেব নারায়ণের বাবাও ছিলেন সাধু। সুজন ন্যাংটা পায়ে কোনো স্যান্ডেল-জুতা পড়েন না গুরুর সম্মানে। কারণ গুরুও পড়তেন না। খাবারের থালা, থাকার কম্বল, পাঁচটি গামছা, নিত্য ব্যবহার্য জিনিস সবসময়ই থাকে নিজের সাথে। তাই যেখানে খুশি সেখানেই রাত্রি যাপন করতে পারেন, হোক রাস্তার ধার, বাসস্ট্যান্ড বা কোনো মাজার।
কোন জাতপাতে বিশ্বাস করেন না। বলেন, মানুষের কর্মফলে আর হিংসায় বিভিন্ন জাতের সৃষ্টি। যেমন কেউ যদি জুতা সেলাইয়ের কাজ করে, আমরা তাকে বলছি 'মুচি', কেউ যদি ড্রেন পরিস্কারের কাজ করে তাকে বলছি ' 'মেথর' এমন না।ককরণ ককরছি কর্মগুণের ওপর। এইসব বিভক্তি করছি আমরা নিজেরা, মানুষেরা। পৃথিবীতে জাতি মূলতঃ দুইটাই, একটা নারী জাতি, একটা পুরুষ জাতি। স্মরণ করিয়ে দেন, লালন কি জাত? জাত সম্পর্কিত লালনের কথাগুলো; জাতের ভেদাভেদ করবেন আপনি ক্যামনে?
বাড়িতে নিজেদের যে মা-বোন অাছে, রাস্তা দিয়ে যারা চলাচল করছেন, তাঁদেরকেেও দেখতে হবে একই দৃষ্টিতে, দৃষ্টি দিয়েও পাপ করা যাবে না।
মানেন- ' মিথ্যা বলাটাই পাপ'। অকপটে স্বীকার করলেন, সামনে পেলে ' সিদ্ধি' সেবন করেন। তবে সমসময় না, পোটলায় পান- সুপারির খিলি রাখেন সুজন ন্যাংটা।
৪৯ বছরের জীবনে তাঁর অনেক অভিজ্ঞতা। খুলনায় থাকার সময় খ্রিস্টান মিশনে যেতেন, অালোচনা করতেন ফাদারদের সাথে, ভাল লাগত। বাচ্চাছেলেমেয়ে বা খুব বয়স্কদের সাধারণত 'বাপ' 'আব্বা' বলে সম্বোধন করেন।
দয়াল, গুরু, কোরান, হাদিস, জল, মন্দির, মসজিদ এই সমস্ত শব্দ কথায় ব্যবহার করে যখন একাকার করে ফেলেন তখন ধর্মীয় পরিচয় খোঁজা সত্যি কঠিন হয়ে যায়! নিজের মনের ভেতর প্রশ্ন উঁকি মেলে, সত্যি কি উনি মুসলমান নাকি হিন্দু? অনেক ধর্মের বিষয়েই অগাধ জ্ঞান রাখেন। ' এইসব বিষয়ে বললে তো তারা বুঝবে না' ' তারা জানে কিন্তু মানে না' আমি কিতাব অনুসারেই কথা বলব। জানাটাই বড় কথা না, মানাটাই বড় কথা। যে কোন বিষয়ে অালোচনা, বাহাসে যেতে প্রস্তুত থাকেন, মা ফাতেমার দুই সন্তান হাসান- হুসেনকে তলোয়ারের নিচে ফেলতে চেয়েছিল কারা? বলেন মাতাল রাজ্জাকের গানের কথাও- আমি মদ খেয়েছি/ মাতাল হয়েছি/ সরে দাঁড়া সব.. ...। জীবৎকালে দেখা পাওয়া হুমায়ন সাধুকে ' বড় সাধু' বলে মানেন। হুমায়ন সাধুকে স্মরণ করতে গিয়ে হাতের লোম দাঁড়িয়ে গেল!
ছবি:পরাগ দা |
পৃথিবীর বড় মাওলানা মাঃ সুলতান কমরুদ্দীন রুমী নেত্রকোণার মদনে আপনাদেরই গারোর কাছে সমস্ত কিছু দিয়েছিলেন। আমি প্রশ্ন করি, মদন যে একজন গারো ছিলেন, তা আপনারা সবাই জানেন? - সবাই জানে না, আমরা অনেকে জানি।
মদনে সুজন ন্যাংটা এক সময় অাগুন ধ্বনি করতেন, আগুন দিয়ে লাঠি খেলা খেলতেন। প্রশাসনের কড়াকড়িতে 'অাগুন লাঠিখেলা' এখন বন্ধ হয়ে গেছে।
সুজন ন্যাংটারা ৪, ভাই, ১ বোন, সেই একমাত্র বোনের সাথে দেখা করলেন এবার ১০ বছর পর। আজমীরে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশের সাধুরা মিলিত হন। এ বছর গেলে সুজন ন্যাংটার যাওয়া পড়বে ২০ বার। এ যেন পৃথিবীতে " জান্নাতুল ফেরদৌস"।
মন্দির- মসজিদ পৃথিবীর পবিত্র স্থান হচ্ছে মা। সন্তান ভাল অাছে, নাকি মন্দ অাছে, সবার অাগে বুঝতে পারেন মা।
" মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি"। সাঁই মানে স্রষ্টা। লালন যখন সাঁই হয়ে নাই হয়ে যান, তখন লালনকেইবা খুঁজে পাব কোথায়?
" কেমনে বুঝাব তোমায়/ লালন আমার কে?/ অামি লালন নই রে ভবে/ দেখ না জ্ঞান চক্ষে"।
No comments