চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও আমার ভাবনা

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও আমার ভাবনা
Probin Tripura


ছবি:প্রবীণ ত্রিপুরা 




এ পর্যন্ত সারা পৃথিবীর মানুষ তিনটি শিল্পবিপ্লবের সাক্ষী হয়েছে। প্রথমটি  ১৭৮৪ সালে বাষ্পিয় ইন্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে ইংল্যান্ডে প্রথম শিল্পবিপ্লব সংগটিত হয়। তারপর ১৮৭০ সালে বিদ্যুৎ আবিষ্কারের মাধ্যমে শিল্প উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ব্যাপক উন্নতি সাধনের মধ্যে দিয়ে দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব সংগটিত হয় এবং এর প্রায়ই ১০০ বছর পর ১৯৬৯ সালে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট আবিষ্কারের মধ্যে দিয়ে তৃতিয় শিল্পবিপ্লব ঘটে। এই শিল্পবিপ্লবের মধ্যে দিয়ে পুরো পৃথিবীতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। বর্তমানে আমরা তৃতিয় শিল্পবিপ্লবে বসবাস করছি।

কিন্তু এর পরেই যে শিল্পবিপ্লব হাতছানি দিয়ে ডাকছে তা হবে ডিজিটাল বিপ্লব বা প্রযুক্তির উন্নয়নের। এই শিল্পবিপ্লবকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নামে অভিহিত করা হচ্ছে। ইন্টারনেট অব থিংকস, থ্রিডি প্রিন্টিং, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ন্যানোটেকনোলোজি, ক্লাউড কম্পিউটিং, জেনেটিক ইন্জিনিয়ারিং, বায়োটেকনোলোজি, ব্লক চেইন, মেশিন লার্নিং এবং রোবটিক্স ইত্যাদির সমন্বয়ে বর্তমান বিশ্বে আমরা যে পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করছি এটাই হচ্ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রভাব। এটি সামাজিক উন্নয়নে, ব্যাবসা বানিজ্যের প্রসারে, শিল্প উৎপাদনে এবং রাষ্ট্র পরিচালনাসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে অনেক অবদান রাখবে। সারা পৃথিবীতে এখন প্রযুক্তির ছোয়া লেগে গিয়েছে এবং তা আস্তে আস্তে এখন উৎকর্ষের সর্বোচ্চ পর্যায়ে যেতে আরম্ভ করছে। বর্তমান বিশ্বে আমরা প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নয়ন লক্ষ্য করতে পারি। যার সহজ উদাহার হচ্ছে স্মার্টফোন। বতর্মানে সকল শ্রেণী পেশার মানুষ স্মার্টফোন ব্যাবহার করছে। আর স্মার্টফোন ব্যাবহারের ফলে মানুষের যেমন উপকার হচ্ছে তেমনিভাবে অপকারও হচ্ছে।


স্মার্টফোন সবার কাছে এখন একটি নিত্যসঙ্গী জিনিস। আজ থেকে ৭ বা ৮ বছর আগেও কিন্তু এমনটা ছিলনা। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ্য উদাহারন হল ইন্টারনেট। ইন্টারনেট পুরো বিশ্বে এখন যেভাবে ব্যাবহার শুরু হয়েছে তা সত্যিই একটি ভয়ানক ব্যাপার। কারন বতর্মানে আমাদের বিভিন্ন কাজ সম্পাদন করা হয় ইন্টারনেটের সহায়তায়। যেমন- যোগাযোগ, অফিসিয়াল কাজ, ব্যবসায় প্রসারের কাজসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ সম্পাদন করা হচ্ছে এর মাধ্যমে। এমনকি বর্তমানে ইন্টারনেট ও প্রযুক্তিকে ব্যাবহার করে বিভিন্ন অপরাধমূলক ও অসামাজিক কর্মকান্ডও বেড়ে চলেছে। আমরা যখন কোন হলিউড সিনেমা বা মুভি দেখি তখন বিভিন্ন চমকৎকার দৃশ্য দেখতে পাই এই সমস্ত কিছু কিন্তু চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এক একটি উদাহারন। যেমন হলিউড বিভিন্ন যুদ্ধ বিষয়ক ছবিতে দেখা যাই যে বিভিন্ন রোবটের মাধ্যমে যুদ্ধ করানো হচ্ছে এবং বিভিন্ন শক্তিশালী যন্ত্রপাতি ব্যাবহার করা হচ্ছে এ সবই কিন্তু চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উদাহারন। এছাড়াও আরেকটি গুরুত্বপূর্ন্য উদাহারন হতে পারে সেটি হল বর্তমানে বিভিন্ন গাড়ি রোবটের মাধ্যমে ও কিছু কিছু স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলছে। এগুলো যদিওবা আমাদের দেশে এখনো দেখা যাইনা কিন্তু বিভিন্ন উন্নত দেশগুলোতে এখন এগুলো ব্যবহারের আরম্ভ হয়েছে।


চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ফলে ব্যবসা বানিজ্যের ও অনেক সহজ হয়ে যাবে। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পন্য দ্রব্য আদান প্রদানে খরচ অনেক কমে যাবে। বিভিন্ন বড় বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকে থাকার জন্য প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে তাল মিলিয়ে তাদের প্রতিষ্ঠানের মানব সম্পদের উন্নয়ন করতে হবে। অল্প কর্মদক্ষতা নিয়ে এই সময়ে টিকে থাকা কোনভাবেই সম্ভব হবেনা। ধারনা করা হচ্ছে এই শিল্পবিপ্লবে যে সমস্ত দেশ ডিজিটাল প্রযুক্তির আবিষ্কার ও সে ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করছে এবং অন্যন্য দেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছে তাদের কাছে অধিকাংশ সম্পদ চলে যাবে। এটিকে জয়ী পক্ষের সব ছিনিয়ে নেওয়ার সাথে তুলনা করা হচ্ছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মানুষরে জীবনে যে পরির্বতন সাধন করবে তার প্রভাব নিয়ে কেউ কেউ ইতিবাচক আবার কেউ কেউ নেতিবাচক মন্তব্য করছেন । এটি যেমনিভাবে মানুষের জীবনকে অনেক সহজ এবং উপভোগ্য করবে তেমনিভাবে আবার চরম ধ্বসাত্নক বয়ে আনবে। প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন মারণাস্ত্র আরও উন্নত ও ব্যবহার করবে। এটিকে যদি নিয়ন্ত্রন করা না যায় তাহলে ধারনা করা হচ্ছে এটিই হইত পৃথিবীতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্ম দিবে।



চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে যে প্রযু্ক্তিগুলো সব থেকে গুরুত্ব পাবে সেগুলো হল ইন্টারনেট অব থিংকস, ক্লাউড কম্পিউটিং ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদি।


Internet of Things (IOT):  এটিকে সংক্ষেপে বলা হয় IOT। আমাদের দৈনন্দিন ব্যাবহার্য বিভিন্ন জিনিসের সাথে যখন ইন্টারনেট সংযুক্ত থাকবে এবং সেটি যখন স্মার্টফোনের মাধ্যমে সব স্থান থেকে নিয়ন্ত্রন করা যাবে আর এই পদ্ধটিতাকেই ইন্টারনেট অব থিংকস বলা হয়। ধরুন আপনি সকালে ঘুম থেকে উঠবেন সকাল ৭ টায় আর আপনি স্মার্টফোনের একটি প্রোগ্রামকে নির্দেশ দিয়ে রাখলেন সকাল ৭ টায় ঘুম থেকে জাগানোর জন্য আর সে প্রোগ্রামটি আপনাকে ঠিক সকাল ৭ টায় ঘুম থেকে জাগিয়ে দিল। এরপর আপনি ব্রাশ করে ফ্রেশ হয়ে সকালের নাস্তার জন্য প্রস্তুত হবেন। তো আপনি মোবাইলে একটা ক্লিকের মাধ্যমেই গোসল খানার ঠান্ডা পানি গরম করে রাখলেন এবং নাস্তার জন্য কফি ও রুটি গরম করে রাখলেন। তারপর গরম পানি দিয়ে ফ্রেশ হয়ে এবং নাস্তা করে তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে এখন অফিসে যাবেন। অফিসে যাবার সময় আপনার মোবাইলে ক্লিক দিয়ে গাড়িটিকে গ্যরেজ থেকে বের করে রাস্তায় দাড়ি করিয়ে রাখলেন যেন গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করার জন্য অতিরিক্ত সময় ব্যায় না হয়। তারপর গাড়িতে করে অফিসে যাচ্ছেন আর সেই গাড়ির কোন ড্রাইভারও নেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলছে। গাড়িতে করে অফিসে যাচ্ছেন এমন সময় আপনার মনে হল যে আপনার বাড়ির দরজা বন্ধ করে যেতে ভুলে গিয়েছেন তখন মোবাইলে একটি ক্লিকেই ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন। এই গুলোই হচ্ছে IOT এর উদাহারন। অর্থাৎ আপনি যখন আপনার স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের সংযোগে কোন একটি প্রোগ্রামের সহায়তায় এই কাজগুলো খুব সহজেই সম্পাদন করবেন তাকেই IOT বলা হয়।
ক্লাউড কম্পিউটিং: বর্তমানে আমরা কম্পিউটারের বিভিন্ন দরকারি ফাইলগুলো বিভিন্ন হার্ডডিস্ক বা স্টোরেজে সংরক্ষন করে রাখি। এর সমস্যা হল একটি নির্দিষ্ট সাইজের ফাইলগুলো রাখা যায় সেটি অতিক্রম হয়ে গেলে সেই স্টোরেজে আর কোন ফাইল রাখা যাবেনা। আর কোন ভাবে সেই ফাইলগুলো যদি মুছে যায় তাহলে তা ফিরে পাওয়া অনেক কষ্টসাধ্য এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা আর ফিরে পাওয়া সম্ভব হয়না। কিন্তু ক্লাউড কম্পিউটিংয়ে আপনি যত খুশি ফাইল সংরক্ষণ করতে পারবেন এবং সেটির মুছে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকেনা। আপনাকে শুধুমাত্র ইন্টারনেটের সহায়তায় আপনার ফাইলগুলো আপলোড করে রাখতে হবে। আর আপনি সেগুলো মোবাইলের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রন করতে পারবেন। এছাড়াও আপনি ক্লাউড কম্পিউটিয়ে আপনার দরকারী যে কোন সফটওয়্যার একটি নির্দিষ্ট টাকা পরিশোধের মাধ্যমে ব্যবহার করতে পারবেন। সেগুলোর আপনাকে আবার নতুন করে আপডেট করতে হবে সেগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপডেট হয়ে যাবে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে মেশিন ইন্টেলিজেন্সও বলা হয়। কোন ইলেকট্রনিক ডিভাইস যখন মানুষের পছন্দ অপছন্দ বুঝতে সক্ষম হবে, কথা শুনে চিনতে পারবে, নতুন জিনিস শিখতে পাবে, পরিকল্পনা করতে পারবে, সমস্যার সমাধান করতে পারবে,  ভাষা বুঝতে পারবে এবং মানুষের মতই কাজ করবে তখন সেই ডিভাইসের এই ক্ষমতাটিকেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বলা হয়। তবে কোন ইলেকট্রনিক ডিভাইস বা কম্পিউটার যন্ত্র কিন্তু নিজে নিজে কাজ করতে পারবেনা তাকে মানুষ যেভাবে দিক নির্দেশনা দিবে সে সেভাবে কাজ করবে। যেমন- আপনি যখন গুগলে কোন কিছু খুজেন তখন আপনার পছন্দনুযায়ী যত তথ্য রয়েছে সব কিছুই আপনাকে দেখিয়ে দেবে।

Probin Tripura 




চতুর্থ শিল্পবিপ্লব সংগটিত হাওয়ার কারনে এদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের মানুষের জীবনে বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে যেমন-


১। মানুষের গোপন তথ্য চুরি হয়ে যাওয়া: বর্তমানে আমরা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমহ বিভিন্ন কাজের জন্য বিভিন্ন সাইট ব্যাবহার করি। যেমন আমরা বর্তমানে অনলাইনে কোন কিছুর ফর্ম পুরন করতে হলে আমাদের নিজেদের ব্যক্তিগত তথ্যগুলো দিতে হই। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান আমাদের সে তথ্যগুলো অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে বড় একটি টাকার অঙ্কের বিনিময়ে বিক্রি করে দেই। আর সে তথ্য তারা তাদের প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ক্যাম্পেইনের কাজে ব্যাবহার করে। এভাবে আমাদের নিজেদের অনেক গোপন তথ্য চুরি হয়ে যেতে পারে। আর একটি বিষয় তা হল আমাদের বিভিন্ন সাইটের প্রোফাইল হ্যাক হয়ে যাওয়া। এর মাধ্যমে আমাদের কিন্তু বড় ধরনের একটি ক্ষতি হয়েও যেতে পারে এবং অনেকে নিজের প্রাইভেসির অনিরাপত্তায় ভুগবেন।

২। অনেক মানুষ চাকরি হারাবে: বিভিন্ন গাড়িগুলো যখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে বা রোবটের মাধ্যমে চলতে সক্ষম হবে তখন যারা গাড়ি চালকের কাজ করে তারা হইত কাজ পাবেনা। বিভিন্ন কলকারখানা বা নির্মানের কাজ যখন রোবটের মাধ্যমে করানো হবে তখন যারা কলকারখানা শ্রমিক বা নির্মাণশ্রমিক তারা চাকরি হারাবে। আর চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের CEO (প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা) হবে রোবট।

৩। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব: বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ চাকরি হারানোর ফলে যারা গরিব তারা আরো গরিব হয়ে পড়বে এবং যারা ধনি তারা আরো ধনি হয়ে উঠবে। এক্ষেত্রে আমাদের দেশের যারা নিম্নশ্রেণীর মানুষ অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
৪। থ্রিডি প্রিন্টিং ব্যবহরের ফলে দেশীয় পুরনো ঐতিহ্যের বিলুপ্তির: আগে আমরা দেখতে পেতাম যে বিভিন্ন রিক্সার পিছনে বিভিন্ন সুন্দর সুন্দর ছবি বা ছায়াছবির দৃশ্য অঙ্কন করা থাকত। বর্তমানে থ্রিডি প্রিন্টিং ব্যাবহারের ফলে আমরা কিন্তু সেগুলো আর দেখিনা। যার ফলে আমাদের দেশিয় পুরনো ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে একই সাথে সেই কাজের সাথে যারা জড়িত ছিল বা সেই পেশায় যুক্ত ছিল আজ তারা বেকার হয়ে পড়ছে।

৫। বিভিন্ন শক্তিশালী ও উন্নত দেশগুলোর মধ্যে প্রযুক্তিগত দ্বন্ধ: চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে সারা বিশ্বের বিভিন্ন শক্তিশালী ও উন্নত দেশগুলো মধ্যে প্রযুক্তিগত দ্বন্ধ দেখা দিবে। যেমন- বিগত কয়েক দিন আগে আমেরিকার অ্যান্ড্রয়েড নির্মাতা প্রতিষ্ঠান চিনের হুয়াই (Huwai) প্রতিষ্ঠানটিকে আর অ্যান্ড্রয়েড সেবা দিবেনা বলে ঘোষনা দিয়েছিল।
লেখক: প্রবীন ত্রিপুরা, চেন্জ মেকার, উপস্থাপক ও পাবলিক স্পিকার।


No comments

Theme images by saw. Powered by Blogger.