গারো অধ্যুষিত অঞ্চলে লকডাউন নিয়ে অমূলক প্রতিক্রিয়া!
গারো অধ্যুষিত অঞ্চলে লকডাউন নিয়ে অমূলক প্রতিক্রিয়া
দেবাশীষ ইম্মানূয়েল রেমা
গারো অধ্যুষিত অঞ্চলে বেশকিছু গ্রাম লকডাউন করা হচ্ছে। লকডাউন নিয়ে একদল প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন। সরাসরি বললে ভালো বিরোধিতা করছেন। যুক্তিতে সম্ভাব্য বিপদের কথাও বলছেন যে প্রয়োজনে এম্বুলেন্স কিংবা ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢুকতে পারবে না। বিপদ হলে কি করবে? বের হওয়ার কিংবা প্রবেশের কোন সুযোগ নেই। আমি মনে করি দুটো কারণে এই প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হচ্ছে —
প্রথমত, গারোদের বা আদিবাসীদের পূর্বপ্রচলিত বেশকিছু প্রথা সম্পর্কে অজ্ঞতা।
দ্বিতীয়ত, দেখা যাচ্ছে দেশের অনেক অঞ্চলে আমাদের বাঙালি ভাইয়েরা গ্রাম বা এলাকা লকডাউন করতে গিয়ে কোন প্রবেশপথ না রেখেই পুরোপুরি ব্যারিকেড দিয়ে দিচ্ছে। যা নিয়ে দেশে সংশয় দেখা দিয়েছে এবং ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের গারোই হোক কিংবা যেকোন আদিবাসীই হোক তাদের রীতি বা প্রথা এমনটি নয়। এখন প্রথম দলের সাথে এই দ্বিতীয় দলকে গুলিয়ে ফেলার কারণেই আমাদের গারো সমাজেও এ নিয়ে বিরোধিতার অবকাশ পেলো।
অনেকেই জানেন না বা প্রয়োজন পড়ে নি বিধায় হয়তো বিস্মৃতপ্রায়, আদিবাসী অনেক জনগোষ্ঠীর মধ্যে কোন বিপর্যয়ের আভাস পেলে বিশেষভাবে মড়ক দেখা দিলে গ্রাম লকডাউন করা হত। গারোরাও এর ব্যতিক্রম ছিল না। এসব ক্ষেত্রে গারোদের মধ্যে যেসব রীতির প্রচলন ছিল —
(১) হুমকিস্বরূপ কিংবা বিপর্যয়ের বাহক বা কারণ বা উৎস এমন কোন সন্দেহজনক ব্যক্তি, প্রাণী বা বস্তুর অনাকাঙ্ক্ষিত প্রবেশ ঠেকাতেই গ্রাম লকডাউন করা হতো। যুবক বা দায়িত্বশীল ব্যক্তিগণ গ্রামের সম্ভাব্য প্রবেশপথগুলিতে পাহাড়া দিতেন। গ্রামের মানুষ অন্যত্র বের হত না। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে প্রয়োজনে বের হওয়া কিংবা প্রবেশের পথ ছিল না।
(২) যে গ্রামে মড়ক দেখা দিত বিশেষভাবে সেই গ্রামকে অবশ্যই বিচ্ছিন্ন করে রাখা হতো। সেই গ্রামের মানুষ অন্য গ্রামে যেতে পারত না অর্থাৎ সেই গ্রাম লকডাউন করা হত।
(৩) মড়ক প্রতিরোধকারী দেবতাকে পূজা-অর্চনা দেওয়া হত।
এখন প্রয়োজনের তাগিদেই আবার জিইয়ে উঠা আমাদের পূর্বপ্রথা নিয়ে যারা অমূলক আশংকা প্রকাশ করছেন তাদের জন্য বলতে হয় আমাদের লকডাউন সিস্টেমে জরুরী আবশ্যিকতার কারণেই প্রবেশপথ থাকে। এম্বুলেন্সের কথা যখন বলছেন তখন বলি এই প্রযুক্তির যুগে এম্বুলেন্সকে ফোন দেওয়ার সময়ই প্রবেশদ্বারটা খুলে দিতে ১/২ মিনিট সময়ও ব্যয় হবে না। গ্রামে কোন বাড়িতে আগুন লাগলো, একজন দায়িত্ব নিয়ে ফায়ার সার্ভিসকে কল করে জানান দিবে নিশ্চয় (যদিও অনেক গ্রামে এখনও ফায়ার সার্ভিসের প্রচলন নেই তবু অভিযোগের নিরিখে বলছি)। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রবেশদ্বার খুলে দিতেও কি খুব সময় নিবে?
তাই বলি গারো অধ্যুষিত বেশ কিছু অঞ্চলে লকডাউন নিয়ে আশংকা অমূলক এবং ভিত্তিহীন। যারা লকডাউন করছে তাদের নিয়ে যেসব সমালোচনার উৎপত্তি ঘটছে সেগুলো অযৌক্তিক এবং ভিত্তিহীন। আমাদের সমাজের জন্য প্রযোজ্য না। আমাদের সমাজ প্রয়োজনের নিরিখেই করছে, হুজুগে না। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যারা অসচেতনভাবে কোন প্রবেশপথের ব্যবস্থা না রেখেই সম্পূর্ণ ব্যারিকেড দিয়ে দিচ্ছে আশংকা হয়তো স্রেফ তাদেরকে নিয়েই করা যায়। তাদের বিষয়ে যে প্রশ্ন বা সংশয় এই একই প্রশ্ন আমাদেরকে করলে বরং সমালোচনাকারীরাই হুজুগে প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে যায়।
ছোটবেলায় নব্বইয়ের দশকেও জরুরী প্রয়োজনে অনেক গ্রামে এমন লকডাউনের ব্যবস্থা দেখেছি।
১. গ্রামে কোন বিপর্যয়ের আশংকা দেখা দিলে গ্রামের সম্ভাব্য প্রবেশ পথগুলো বাঁশের বেড়া বেঁধে বন্ধ করে দেওয়া হতো।
২. প্রয়োজনে স্বেচ্ছাসেবক যুবকেরা গ্রামের প্রতি প্রবেশপথে পাহারা দিত, লকডাউনের পূর্বে গ্রামের প্রতি ঘরে গিয়ে সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে জ্ঞাত করাসহ লকডাউন ও বিশেষত রাতে যুবকদের পাহারা দেওয়া বিষয়ে ঘোষণা করত। বহিরাগতদের প্রবেশে কড়াকড়ি ছিল বলতে বরং নিষেধাজ্ঞাই ছিল।
৩. কিন্তু এই ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে অনেক গ্রামে। আমাদের প্রতিবেশী জাতিসত্তা আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসতি স্থাপন করার পর এখন এই কাঠামো জিইয়ে রাখা সম্ভবপর হয়ে উঠে না অনেক গ্রামেই।
তবু গ্রাম বন্ধ সম্ভব না হলেও নিজেদের বাড়িতে প্রবেশের গেইটসহ বাড়ি-ভিটে সব বেড়া বেঁধে নিজেদের বাড়িটা সম্পূর্ণ লকডাউন করে দিত। প্রবেশপথের গেইট তালাবদ্ধ করে রাখা হত। রাস্তাই শুধু প্রখর রোদে এক শুন্যতায় খাঁ খাঁ করত। অপরিচিত কারোর গেইট পেরিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশে অনুমতি ছিল না। প্রয়োজনে হয়তো বের হত এমনকি নিতান্তই প্রয়োজন ছাড়া প্রতিবেশীদের কেউ কারোর উঠানে পর্যন্ত পা পড়ত না। সব কিছুই নিজ দায়িত্বে হত। আর সন্ধ্যার পর থেকে তো স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজ নিজ তাগিদে-দায়িত্বে এক অলিখিত সান্ধ্য আইন শুরু হয়ে যেত।
সবাই দূরত্ব বজায় রাখত যথাসম্ভব। এখনও অন্তত তাই হোক যেখানে যেখানে এলাকা লকডাউন সম্ভব না সেসব জায়গায় নিজেদের বাড়িভিটে অন্তত এভাবেই সুরক্ষিত করা হোক।
দেবাশীষ ইম্মানূয়েল রেমা
ছবি-লেখক। |
গারো অধ্যুষিত অঞ্চলে বেশকিছু গ্রাম লকডাউন করা হচ্ছে। লকডাউন নিয়ে একদল প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন। সরাসরি বললে ভালো বিরোধিতা করছেন। যুক্তিতে সম্ভাব্য বিপদের কথাও বলছেন যে প্রয়োজনে এম্বুলেন্স কিংবা ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢুকতে পারবে না। বিপদ হলে কি করবে? বের হওয়ার কিংবা প্রবেশের কোন সুযোগ নেই। আমি মনে করি দুটো কারণে এই প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হচ্ছে —
প্রথমত, গারোদের বা আদিবাসীদের পূর্বপ্রচলিত বেশকিছু প্রথা সম্পর্কে অজ্ঞতা।
দ্বিতীয়ত, দেখা যাচ্ছে দেশের অনেক অঞ্চলে আমাদের বাঙালি ভাইয়েরা গ্রাম বা এলাকা লকডাউন করতে গিয়ে কোন প্রবেশপথ না রেখেই পুরোপুরি ব্যারিকেড দিয়ে দিচ্ছে। যা নিয়ে দেশে সংশয় দেখা দিয়েছে এবং ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের গারোই হোক কিংবা যেকোন আদিবাসীই হোক তাদের রীতি বা প্রথা এমনটি নয়। এখন প্রথম দলের সাথে এই দ্বিতীয় দলকে গুলিয়ে ফেলার কারণেই আমাদের গারো সমাজেও এ নিয়ে বিরোধিতার অবকাশ পেলো।
অনেকেই জানেন না বা প্রয়োজন পড়ে নি বিধায় হয়তো বিস্মৃতপ্রায়, আদিবাসী অনেক জনগোষ্ঠীর মধ্যে কোন বিপর্যয়ের আভাস পেলে বিশেষভাবে মড়ক দেখা দিলে গ্রাম লকডাউন করা হত। গারোরাও এর ব্যতিক্রম ছিল না। এসব ক্ষেত্রে গারোদের মধ্যে যেসব রীতির প্রচলন ছিল —
(১) হুমকিস্বরূপ কিংবা বিপর্যয়ের বাহক বা কারণ বা উৎস এমন কোন সন্দেহজনক ব্যক্তি, প্রাণী বা বস্তুর অনাকাঙ্ক্ষিত প্রবেশ ঠেকাতেই গ্রাম লকডাউন করা হতো। যুবক বা দায়িত্বশীল ব্যক্তিগণ গ্রামের সম্ভাব্য প্রবেশপথগুলিতে পাহাড়া দিতেন। গ্রামের মানুষ অন্যত্র বের হত না। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে প্রয়োজনে বের হওয়া কিংবা প্রবেশের পথ ছিল না।
(২) যে গ্রামে মড়ক দেখা দিত বিশেষভাবে সেই গ্রামকে অবশ্যই বিচ্ছিন্ন করে রাখা হতো। সেই গ্রামের মানুষ অন্য গ্রামে যেতে পারত না অর্থাৎ সেই গ্রাম লকডাউন করা হত।
(৩) মড়ক প্রতিরোধকারী দেবতাকে পূজা-অর্চনা দেওয়া হত।
এখন প্রয়োজনের তাগিদেই আবার জিইয়ে উঠা আমাদের পূর্বপ্রথা নিয়ে যারা অমূলক আশংকা প্রকাশ করছেন তাদের জন্য বলতে হয় আমাদের লকডাউন সিস্টেমে জরুরী আবশ্যিকতার কারণেই প্রবেশপথ থাকে। এম্বুলেন্সের কথা যখন বলছেন তখন বলি এই প্রযুক্তির যুগে এম্বুলেন্সকে ফোন দেওয়ার সময়ই প্রবেশদ্বারটা খুলে দিতে ১/২ মিনিট সময়ও ব্যয় হবে না। গ্রামে কোন বাড়িতে আগুন লাগলো, একজন দায়িত্ব নিয়ে ফায়ার সার্ভিসকে কল করে জানান দিবে নিশ্চয় (যদিও অনেক গ্রামে এখনও ফায়ার সার্ভিসের প্রচলন নেই তবু অভিযোগের নিরিখে বলছি)। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রবেশদ্বার খুলে দিতেও কি খুব সময় নিবে?
তাই বলি গারো অধ্যুষিত বেশ কিছু অঞ্চলে লকডাউন নিয়ে আশংকা অমূলক এবং ভিত্তিহীন। যারা লকডাউন করছে তাদের নিয়ে যেসব সমালোচনার উৎপত্তি ঘটছে সেগুলো অযৌক্তিক এবং ভিত্তিহীন। আমাদের সমাজের জন্য প্রযোজ্য না। আমাদের সমাজ প্রয়োজনের নিরিখেই করছে, হুজুগে না। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যারা অসচেতনভাবে কোন প্রবেশপথের ব্যবস্থা না রেখেই সম্পূর্ণ ব্যারিকেড দিয়ে দিচ্ছে আশংকা হয়তো স্রেফ তাদেরকে নিয়েই করা যায়। তাদের বিষয়ে যে প্রশ্ন বা সংশয় এই একই প্রশ্ন আমাদেরকে করলে বরং সমালোচনাকারীরাই হুজুগে প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে যায়।
ছোটবেলায় নব্বইয়ের দশকেও জরুরী প্রয়োজনে অনেক গ্রামে এমন লকডাউনের ব্যবস্থা দেখেছি।
১. গ্রামে কোন বিপর্যয়ের আশংকা দেখা দিলে গ্রামের সম্ভাব্য প্রবেশ পথগুলো বাঁশের বেড়া বেঁধে বন্ধ করে দেওয়া হতো।
২. প্রয়োজনে স্বেচ্ছাসেবক যুবকেরা গ্রামের প্রতি প্রবেশপথে পাহারা দিত, লকডাউনের পূর্বে গ্রামের প্রতি ঘরে গিয়ে সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে জ্ঞাত করাসহ লকডাউন ও বিশেষত রাতে যুবকদের পাহারা দেওয়া বিষয়ে ঘোষণা করত। বহিরাগতদের প্রবেশে কড়াকড়ি ছিল বলতে বরং নিষেধাজ্ঞাই ছিল।
৩. কিন্তু এই ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে অনেক গ্রামে। আমাদের প্রতিবেশী জাতিসত্তা আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসতি স্থাপন করার পর এখন এই কাঠামো জিইয়ে রাখা সম্ভবপর হয়ে উঠে না অনেক গ্রামেই।
তবু গ্রাম বন্ধ সম্ভব না হলেও নিজেদের বাড়িতে প্রবেশের গেইটসহ বাড়ি-ভিটে সব বেড়া বেঁধে নিজেদের বাড়িটা সম্পূর্ণ লকডাউন করে দিত। প্রবেশপথের গেইট তালাবদ্ধ করে রাখা হত। রাস্তাই শুধু প্রখর রোদে এক শুন্যতায় খাঁ খাঁ করত। অপরিচিত কারোর গেইট পেরিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশে অনুমতি ছিল না। প্রয়োজনে হয়তো বের হত এমনকি নিতান্তই প্রয়োজন ছাড়া প্রতিবেশীদের কেউ কারোর উঠানে পর্যন্ত পা পড়ত না। সব কিছুই নিজ দায়িত্বে হত। আর সন্ধ্যার পর থেকে তো স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজ নিজ তাগিদে-দায়িত্বে এক অলিখিত সান্ধ্য আইন শুরু হয়ে যেত।
সবাই দূরত্ব বজায় রাখত যথাসম্ভব। এখনও অন্তত তাই হোক যেখানে যেখানে এলাকা লকডাউন সম্ভব না সেসব জায়গায় নিজেদের বাড়িভিটে অন্তত এভাবেই সুরক্ষিত করা হোক।
No comments