হাজং মাতা রাশিমণি

জা'ডিল মৃ






জানো তো খুব স্বপ্ন জাগে, একদিন হাজং মাতা  রাশিমণি মানুষটি কে দেখতে যাব,উনার স্মরণে যে মেলা হয় যে অনুষ্ঠান হয় যে স্মৃতিসৌধ আছে সেটা দেখতে যাব। যদিও তিনি এখন শারীরিক ভাবে বেঁচে নেই,নিজের জাতির জন্য সংগ্রামরত অবস্থায় শহীদ হয়েছেন।কিন্তুু এখনো তিনি হাজং জাতিগোষ্ঠী মধ্যে বেঁচে আছেন,আমাদের মধ্যে বেঁচে আছেন,সংগ্রাম আন্দোলনের প্রেরণা উৎস, হাজং মাতা রাশিমণি । আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে হাজং মাতা রাশিমণি,উনার সংগ্রাম,আন্দোলন এবং জীবন দান।


আমরা সচারচর শুনে থাকি বা অভ্যস্ত, অধিকার সংগ্রাম আন্দোলনে শুধু শহীদ হয়  পুরুষেরা।কিন্তুু একজন নারীও যে নিজের জীবন দান করতে পারে দ্বিধাবোধ ছাড়া,সেটা আমাদের মগজে ঢুকে না।প্রতিটা সংগ্রাম আন্দোলনে পিছনে নারীর অবদান কিন্তুু অপরিসীম, শহীদ হয় না বলে আমাদের কাছে তেমন গুরুত্ববহনন করে না,অর্থাৎ সঠিক উপলদ্ধি দ্বারাই নারীদের অবদান বুঝা সম্ভব।আমাদের কাছে সংগ্রামরত অবস্থায় শহীদ হওয়া বাস্তব প্রমাণ এই যে,হাজং মাতা রাশিমণি। যিনি নিজের জাতির অস্তিত্ব রক্ষাতে,জুলুম, অত্যাচার, নিপীড়নেরর হাত থেকে বাঁচাতে জাতির সংকটময় সময়ে ঐকের ডাক দিয়েছিলেন।আমি জানি অনেকের কাছে অবিশ্বাস লাগবে ব্যাপারটা,কিন্তুু এটাই সত্য,একজন নারীর যে সংগ্রাম করে শহীদ হতে পারে,অনেকের কাছে ধারণার বাইরে।নারীকে সচারচর আমরা দুর্বল, নিচুজাত,পণ্য আবাল ভেবেই এসেছি।তবে আদিবাসীদের সংগ্রাম আন্দোলনে বা প্রতিটা আন্দোলনের ক্ষেত্রে নারীদের অবদান অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।সংগ্রাম আন্দোলনে নারী হচ্ছে প্রধান শক্তি এবং অনুপ্রেরণা জায়গা।যদি সংগ্রাম আন্দোলনে নারীর অংশগ্রহণ না থাকে, সেটা পূর্ণতা পাই বলে,আমি মনে করি না।প্রত্যেক আদিবাসী  আন্দোলনে নারীর অবদান অস্বীকার্য।নিজের কোন সন্তান না থাকলে আজকে উনি পুরো জাতির মাতা।এটি কি ভাবা যায় সন্তানহীন মাতা?এখন এটাই বাস্তবতা  উনাকে" হাজং মাতা রাশিমণি " নামেই ডাকা হয়। আসলে, কি কারণে হাজং জাতিগোষ্ঠীর কাছে; এছাড়াও অন্যন্য আদিবাসী জাতিসমূহের কাছে গুরুত্বপূরর্ণ হাজং মাতা রাশিমণি,  সেটাই সংক্ষিপ্ত আকারে এবং উনার কাজ সম্পর্কে  আলোচনা করব।

হাজং মাতা রাশিমণির জম্মস্থান নিয়ে দুই ধরণের মতভেদ দেখলাম কেউ বলে দূর্গাপুর আবার কেউ বলে নালিতাবাড়ি, জম্মসন নিয়েও বিপাকে পড়েছি কোথাও লেখা আছে ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দ  আবার কোথাও দেওয়া আছে ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দ ,উনার জম্মস্থান জম্মসন বিভ্রাতকর।   । আমি ঠিক জানি না কোনটা সত্য বা আনুমানিক। যাই হোক,তিনি দারিদ্র্যতার  কারণে লেখাপড়ারর সুযোগ পাননি।কিন্তুু পাঠ্য বইয়ের পড়া শিখতে না পারলেও বাইরে জগৎ থেকে অনেক কিছু শিক্ষা লাভ করেছিলেন।তিনি হয়ে উঠেছিলেন নারী সংগঠক,সাহসী নেত্রী,সংগ্রামী, বিপ্লবী এবং জাতির কাছে আলো পথের দিশারী।কিশোর দুয়ার পার না হতেই খুব অল্প সময়ে মাত্র ১২/১৬ আনুমানি বছর বয়সে পাঁচ মণ ধান ও নগদ দশ টাকার বিনিময়ে জ্ঞনেন্দ্র হাজং নামক  লোকের সাথে বিয়ে হয়।যিনি টংক প্রথার সাথে সংপৃক্ত ছিলেন। কিন্তুু তিনি বেশিদিন বাঁচেননি,অল্প বয়সে হাজং মাতা রাশিমণি বিধবা হয়ে যান।ফলত দুঃখের সময় পার হতে থাকে,দুমুঠো খাবার জোগানোর জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হতো, ফলে দারিদ্র গ্লানি তাকে অসহনীয় করে তুলে।জানা যায়,তিনি দ্বিতীয় বার বিয়ে করেন ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে।জানা যায় কোন সন্তান না হওয়ার কারণে অনেকে ডাইনি হিসাবে সম্মোধন করতো।কিন্তুু তাতে তিনি পাত্তা দিতেন না,নিজের কাজেই বেশি মনোযোগী ছিলেন।

টংক আন্দোলন মূলত শুরু হয় জমিদারদের  অত্যাচার, জুলুম, নিপীড়ন এর কারণে। টংক প্রথা ছিল মূলত ফলস হোক না হোক জমিদারকে নির্দিষ্ট পরিমাণে ফসল দিতে হতো সেটা বাজার থেকে কিনে হোক ধার করে হোক।যদি দিতে না পারতো তাঁর উপর নেমে আসতো অত্যাচার, জুলুম।এই অত্যাচার অসহনীয় মাত্রায় চলে গিয়েছিলো।হাজং মাতা রাশিমণি টংক আন্দোলনে নিজে সংপৃক্ত করে,দুূর্বাল আন্দোলন করে তুলেন।

প্রথম জমিদারদের সাথে পরবর্তীকাল ব্রিটিশ সরকারে সাথে টংক প্রথা নিয়ে বিরোধ লাগে। হাজং জাতিগোষ্ঠী টংক প্রথা বিলোপ চান ,একি সাথে সব ধরনের খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দেন। এই সূত্র ধরে  জমিদার এবং ব্রিটিশ সরকার হাজং জাতিগোষ্ঠী উপর অত্যাচার, জুলুম, নির্যাতন, নিপীড়ন বাড়াতে থাকে।যে কয়টি হাজং গ্রাম জমিদার ও ব্রিটিশ বিরোধী ছিল, তার মধ্যে হাজং মাতা রাশিমণির গ্রাম অন্যতম ছিল।আন্দোলন সংগ্রাম তীব্র করতে পুরোপুরি নিজেকে সংপৃক্ত করেছিলেন হাজং মাতা রাশিমণি, সেই সুবাধে বিভিন্ন গ্রাম এলাকাতে যেতেন,লোকদের বুঝাতেন যে এই আন্দোলন কতটা দরকার।আন্দোলন বিশাল আকারে রুপ নিয়েছিলো।ফলত ব্রিটিশ সরকার আন্দোলন দমানোর জন্য বিভিন্ন জায়গায় ক্যাম্প স্থাপন করে।অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে তুলে,ক্যাম্পে লোকদের ধরে নিয়ে যেত অত্যাচার চালাত, আন্দোলনের শাস্তি হিসাবে।আন্দোলন এমন ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছিল যে ব্রিটিশ সরকার আন্দোলন দমানোর জন্য নিরীহ লোকদের কোন কারন ছাড়াই গুলি করে হত্যা করতো।এতো সবকিছু পরেও হাজং মাতা রাশিমণি দমে যাননি।তিনি আন্দোলন চালিয়ে যান।

এক পর্যায়ে ব্রিটিশ সরকার আন্দোলনকারীদের ধরার জন্য গ্রামের পর গ্রাম তল্লাশি চালায়।তল্লাাশি চালাতে চালাতে বহেরাতলী গ্রামে যান, সেখানে বসবাসরত লংকেশ্বর হাজং এবং তিন ভাই সহ টংক আন্দোলনে সরাসরি সংপৃক্ত ছিল।কিন্তুু লংকেশ্বর হাজংকে বাড়িতে না পেয়ে  বিবাহিত নতুন বউকে ব্রিটিশ বাহিনী ক্যাম্পের দিকে জোর করে টেনে নিয়ে যায়।এই খবর সারা হাজং গ্রাম এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।

 তখন ছিল ৩১ জানুয়ারি  ১৯৪৬ সাল সকাল বেলা। অন্যদের মতামত উপেক্ষা করে, যারা সহমত পোষণ করতো, অল্প কিছু মানুষ নিয়ে এই বিশাল ব্রিটিশ বাহিনীর পথরোধ করে,হাজং মাতা রাশিমণি ও সহযোদ্ধারা।সহযোদ্ধারা বিনা শর্তে কুমুদিনী হাজং কে ছেড়ে দিতে বলেন,কিন্তুু ব্রিটিশ বাহিনী ছেড়ে দিতে অস্বীকৃতি জানাই,ফলত হাজং মাতা রাশিমণি   ব্রিটিশ বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন ।  হাজং মাতা রাশিমণি কুমুদিনী হাজং কে বাঁচাতে এগিয়ে গিয়ে তখন তিনি নাকি বজ্রকন্ঠে বলেছিলেন," ‘ময় তিমাদ, তিমাদ হুয়ে আরেগ তিমাদলা মান ময় বাঁচাব, মরিবা লাগে মুরিব।’ অর্থ: ‘আমি নারী, নারী হয়ে আরেক নারীর সম্ভ্রম রক্ষা আমিই করব, মরতে হয় মরব"।হাজং মাতা রাশিমণির এই সুন্দর বাক্য স্মৃতিসৌধে সুন্দর ভাবে লেখা আছে।কুমুদিনী হাজং কে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন দান করে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।একজন নারীর সম্মান রক্ষা করতে আরেকক নারীর প্রাণ দেওয়া,  যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।

জানা যায়, হাজং মাতা রাশিমণির স্মৃতি রক্ষাতে ২০০৪ সালে স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়।শুধু নারী সম্মান রক্ষা জন্য নয়, তিনি পুরো হাজং জাতির মুক্তি চেয়েছিলেন।জমিদার
এবং ব্রিটিশ বাহিনীর অত্যাচার, জুলুম নিপীড়ন, বৈষম্য, সংগ্রাম আন্দোলন করে হাজং জাতি কে মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন।কিন্তুু আজও হাজং জাতিগোষ্ঠী মুক্তি লাভ করেনি, সংগ্রাম আন্দোলন এখনো চলমান।

হাজং মাতা রাশিমণি  মরে নাই,শারীরিক মৃত্যু হয়েছে ঠিক,কিন্তুু আমাদের অন্তরে বেঁচে আছে বেঁচে থাকবে যুগের পর যুগ প্রজম্মের পর প্রজম্ম।

মুক্তি সংগ্রাম দীর্ঘজীবী হোক।

লাল সালাম।




No comments

Theme images by saw. Powered by Blogger.