ফিরে দেখা খাগড়াছড়ি (দ্বিতীয় অংশ)

জা'ডিল মৃ





অনেকক্ষণ বাদে খাগড়াছড়ি সদরে পৌঁছালাম,গাড়ি থেকে নেমে ভিডিও রেকডিং আবার শুরু করলাম,একটানে জোরে শ্বাস নিয়ে বিশুদ্ধ বাতাস নিলাম,বিস্ময়কর ভাবে আবিমার বাতাসের মত ঘ্রাণ পেলাম।আমাদের গাড়িতে অনেক ট্রুরিস্ট এখন বসে ছিল, অনেকে নেমে হোটেলের খোঁজে চলে গেল। আমার আবার হোটেলের প্যারা ছিল না, সোজা বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিলাম।গাড়ি থেকে নামার পর হাঁটা দিলাম এত পরিষ্কার শহর, মানুষজন কম,রাস্তা মোটামোটি বড়,যেমটা ভেবেছিলাম তার চাইতেও শহরটা অনেক বড়,সকালের কারণে মানুষজন কম ছিল। কোন অটো না পাওয়ায় তিনজন মিলে হাঁটা শুরু করলাম, খারপ লাগছিল না হাঁটতে ,ভালোই উপভোগ করছিলাম, সারা রাত বসে থাকা খুব কষ্টের কাজ,খুব প্যারাময়,ভাবছিলাম  মুক্ত ভাবে হাঁটতে পারাটাই মুক্তির সামিল।রেকডিং তখনো চলছিল,হাঁটতে হাঁটতে ছোট একটা ব্রিজে চলে এলাম, খুব সুন্দর, দুইটো অংশকে এক করেছে, এই ব্রিজ ছাড়া শহরের  অপূর্ণতা থেকে যাবে কারণ দুটো অংশ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।শহরের গোল চত্বরের চলে গেলাম, সেখানে থেকে অটোতে খাগড়াপুর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।উঁচুনিচু রাস্তা পেরিয়ে পাহাড় ছেড়ে সমতলে চলে এলাম,এক জায়গায়  আমার ছোট বুনিং বিটন নেমে গেল।

ভাবছিলাম এত দূর, জিঙ্গাসা করলাম বড় বুনিং কে আর কত?সে বললো"এই তো চলে এসেছি"বসে থাকতে খুব প্যারা লাগছিল,ভেবেই অস্থির হচ্ছিলাম কবে যে ঘুরতে যেতে পারব!
আমাদের অটোতে দুটো মারমা মহিলা উঠেছিল কি যেন কথা বলছিল বুঝতে পারিনি।বড় বুনিং কে জিঙ্গাসা করলাম "কি বলেছে রে"?বললো"সেও জানে না"।হঠাৎ করে একটা জায়গায় থামলাম,সেটা যে খাগড়াপুর আমার জানা ছিল না।আশপাশ দেখলাম কিছু আদিবাসী দোকান, শীতকাল তো অনেকে আগুনের বসে ছিল,কেন জানি আমাদের দিকে চেয়ে কি জানি পরোক্ষ করছিল,কিছু বুঝতে পারেনি।বড় বুনিং সিঁড়ি বেড়ে উপরে উঠতে থাকে আমিও তাকে অনুসরণ করে উঠি, রেকডিং চালু করলাম।আঁকা বাঁকা পথ পাড়ি দিয়ে হাঁটতে থাকলাম,কিছু সময় বাদে চারিদিকে দেওয়াল দেওয়া দরজার সামনে চলে এলাম,বুনিং একটু লজ্জায় লাল হয়ে বলতে লাগলো এই হচ্ছে" আমার কুঁড়ে ঘর"বলেই জিব্বায় কামড় দিল,আমাকে জিব্বার কামড়ের দৃশ্য ফাঁকি দিতে পারল না।আমি অবাক হয়ে গেলাম,মনে মনে ভেবেছিলাম মোটেও সেটা কুঁড়েঘর নয়,বলাও ঠিক না,প্রথম দেখাতে ঘরটা খুব পছন্দ হয়েছিল।ঘরের কারুকার্য আমার কাছে অস্থির লেখেছিল।

 বুনিং এর বাবা মানে আক্কেল কার সাথে যেন কথা বলছিল,আমরা দরজায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে  ভেতরে ঢুকে পড়লাম, কথা শেষ করে আক্কেল হাত বাড়িয়ে দিলেন,আমি থতমত খেলাম।আমি অপ্রস্তুত অবস্থায় ছিলাম,তখন আমার মগজে ছিল না, হাত মিলিয়ে কর্মদন করতে হবে।ছোটখাটো বিষয় নিয়ে কথা হলো,বিশ্রামে জন্য ভেতরে পাঠিয়ে দিলেন।হাত পা ধুয়ে খাবারের টেবিলে বসে পড়লাম,খুব তৃপ্ত নিয়ে খেলাম, আমি গারো এবং ত্রিপুরা খাবারে মধ্যে এত পার্থক্য দেখলাম না,পেট ভরে খেয়েছিলাম এক ধরণের  দারুণ স্বাদ পেয়েছিলাম।খাওয়া দাওয়া ব্যাপার বলতে গেলে একটা কথাই মনে আছে সেটা হলো" মাশরুম", পাহাড়ি মাশরুমের স্বাদের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম,অনেক দিন খাওয়ার ভাগ্য হয়নি,তবে ছোটবেলার যে মাশরুম খেয়েছিলাম সেই রকমি স্বাদ পেয়েছিলাম।রাঙামাটিতে খাওয়া মাশরুম তেমন মজাদার স্বাদ ছিল না।যদি কোন দিন আবার খাগড়াছড়ি যাওয়া হয় অবশ্যই মাশরুমের স্বাদ না নিলে স্বার্থক হবে না।

মন খুব ছটফট করছিল বাইরে ঘুরতে যাব, মন কেন জানি বসে থাকতে ইচ্ছা করছিল না। বার বার মনে হচ্ছিল যত সম্ভব তাড়াতাড়ি ঘুরতে যেতে হবে, সময় কম,মনের ভেতনমর প্রচন্ড তাগাদা ছিল যত কম সময়ে সবকিছু ঘুরা যায়।বুনিং কে তাগাদা দিলাম ঘুরতে যাব, আমার কোন কথা শুনলো না,গাড়িতে ঘুম হয় নাই বলে শুয়ে পড়ল।আমার আর কী করার বন্ধুর কথা মত শুয়ে পড়লাম,কিন্তুু চোখে ঘুম এলো না বুনিং এর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন সে ঘুম থেকে উঠে। সেদিন আর জোর করিনি কোথাও,সে যেখানেই নিয়েগেছে চুপ মেরে অনুসরণ করেগেছি।তখন পরিবেশটা খুব গরম ছিল পুরো খাগড়াছড়ি শহর থমতমে ছিল,কোন সময় কি হয়ে যায়!শেষ পর্যন্ত বিকালে  একটু ঘুরতে বের হলাম,আক্কেল আন্টি তাড়াতাড়ি আসতে বললেন।আশপাশ দিয়ে ঘুরলাম কিছুক্ষণ, সদরে চলে গেলাম মানে কাঁচা বাজারে ঘুরে ফিরে সবকিছু দেখলাম,মনে মনে আদিবাসী দোকান খুঁজেছিলাম কিন্তুু আমি হতাশ হয়েছিলাম, যেমনটা আশা করেছিলাম মারাত্মক ভাবে স্বপ্ন ধ্বংস হলো। যেতে যেতে দীর্ঘ চেঙ্গি নদী ব্রিজে কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। বসে বসে ভাবতে লাগলাম, আদিবাসী এলাকা,আদিবাসী শহর,আদিবাসী মানুষ, বই, পত্রিকা,অনলাইনে কত পড়েছি! সন্ধ্যা না হওয়া পর্যন্ত চাররপাশ এলাকা বোঝার চেষ্টা করলাম।কোথার কোথায় গিয়েছিলাম সেটা আর মনে নেই, তবে যেটুকু আংশিক মনে আছে সেটা নিয়েই কথা বলব।

পরের দিন সকালে নাস্তা খেয়ে আবার বাজারে চলে গেলাম,আদিবাসী ব্যবসায়ি আদিবাসী ক্রেতা বিক্রেতা দেখে মন ভরে গেল(কাঁচা বাজার)।ভিডিওতে দেখতাম আদিবাসী ক্রেতা বিক্রেতা নিজস্বতা পরিবেশে নিজেদের পণ্য বিক্রয় করছে,যেটি অনেক দিন থেকেই দেখার বড়ই স্বপ্ন ছিল।আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল"আদিবাসী বাজার",অন্যদের কাছে কেমন লাগে আমি জানি না!অনেক আগে আমাদেরও এরকম বাজার ছিল যেখানে গারো ক্রেতা বিক্রেতা সমাগম হতো।আজকে এই সময়ে এসে তা দেখা যায় না।পুরো খাগড়াছড়ি ভ্রমণ আমি ভিডিও এবং ছবির মাধ্যমে স্মরণীয় করে রেখেছি। আমি জানি, প্রথম খাগড়াছড়ি ভ্রমণে অনুভূতি দ্বিতীয় বার গেলে আর হবে না।

এই পাহাড় এই আদিবাসী জমি আদিবাসী এলাকা আদিবাসী সংস্কৃতি আদিবাসী বাজার আদিবাসী জনগোষ্ঠী আমায় বার বার টানে। আমারর বিশ্বাস আবার আমি যাব কোন একদিন ,যদি বেঁচে থাকি যেতে চাই গভীর অরণ্যের পথ,মনোমুগ্ধকর দৃশ্য ভরা গ্রাম,যেখানে রাস্তা নেই, কারেন্ট নেই,নের্ট নেই,দোকান নেই,বড় বাজার নেই,মার্কেট নেই এই সব আদিবাসী এলাকায়।আমি জানি না, আমি আবার যেতে পারব কি না; কিন্তুু আমার স্বপ্ন বেঁচে থাকবে মনের ভেতর। আমি একদিন আবার যাব যদি বেঁচে থাকি।

No comments

Theme images by saw. Powered by Blogger.