পা রাজা পরেশ চন্দ্র মৃ
জা'ডিল মৃ
ইতিহাস ঘাঁটালে দেখা যায়, দফায় দফায় আবিমায়(মধুপুর)বসবাসরত শান্তিপ্রিয় আদিবাসীদের উচ্ছেদের জন্য সরকার নানান কৌশল প্রয়োগ করে স্বাভাবিক জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। আবিমা গারোদের ইতিহাস হচ্ছে সংগ্রামের ইতিহাস। পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে বর্তমান সময়েও সরকার নানা রকম ভাবে উচ্ছেদের জন্য ফাঁদ করে রেখেছে। কিন্তুু গর্বের কথা হচ্ছে, যতবার সরকার উচ্ছেদের নোটিশ দিয়েছে,গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বলেছে ততবার প্রতিহত করা হয়েছে(কিছু গ্রাম রেহাই পাইনি)।আমাদের অবিসংবাদিত নেতা যার জীবনী এখন বই আকারে প্রকাশ করা হয়নি। সেই জন্য সবার জ্ঞাতাতে তার জীবন নিয়ে সংক্ষিপ্ত আকারে আলোচনা করা হল। কাজের মাধ্যমে তিনি মানুষের মন জয় করেছিলেন বলেই, সবাই খুশি হয়ে তাকে "গারোদের রাজা "হিসাবে ভূষিত করেন।
পা রাজা পরেশ চন্দ্র মৃ জম্মগ্রহণ করেন চুনিয়া নামক গ্রামে ১৯২৯ সালে।উনার মার নাম ছিল দেওয়া মৃ এবং বাবার নাম রায়চান নকরেক।উনারা দুই ভাই ছিলেন বড় ভাই গজেন্দ্র মৃ এবং( তিনি) পরেশ চন্দ্র মৃ।উনার বাবা খুব বুদ্ধিমান এবং দূরদর্শী লোক ছিলেন। সেই কারণে দুই ভাইকে পড়াশুনার জন্য স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন, ভূটিয়া গ্রামে অবস্থিত ব্যাপ্টিস মিশনারি পরিচালিত স্কুলে ।পা রাজা পরেশ চন্দ্র মৃ পড়াশুনায় অনেক মেধাবী ছিলেন এবং দূরদর্শী ছিল প্রখর।সেই সময় ৪র্থ শ্রেণীতে হলে,বৃত্তির জন্য পরীক্ষা দেওয়া বাধ্যতা মূলক ছিল। তখনকার সময়ে গাড়ি ঘোড়া তেমন ছিল না পায়ে হেঁটে ১৭মাইল পথ পাড়ি দিয়ে পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। তিনি সেই পরীক্ষা ২য় স্থান অধিকার করেছিলেন।পড়াশুনা জন্য কোন অজুহাতকে তিনি প্রশ্রয় দেননি,তিনি পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি প্রচুর বই পড়তেন। পড়াশুনার সময়, হিন্দু বাড়িতে লজিং থাকার সুবাধে যার বাড়িতে থাকতেন, সেই বাড়ির কর্তা তাকে খুব ভালোবাসতেন। তিনি রাজনীতি এবং ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন,হিন্দু না হওয়া সত্ত্বেও তিনি বিভিন্ন বিষয়ে পা রাজা পরেশ চন্দ্র মৃ কে শিক্ষা দিতেন,যেমন,রাজনীতি,অর্থনীতি, রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, বেদান্ত ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষা দিতেন।কিন্তুু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস,অগোচরে যক্ষ্মা বাসা বাঁধতে থাকে তার দেহে, অজান্তে এক পর্যায়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন।তখকার একটা খুব জনপ্রিয় কথা ছিল"যার হয় যক্ষ্মা, তার নাই রক্ষা"।ফলত বার বার অসুস্থ থাকার কারণে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বেশি দূর লেখাপড়া করতে পারেনি।তবে পাঠ্য বইয়ের পাতা পাশ করতে না পারলেও,বাইরের বই পড়তে কখনো ভুলে যাননি। তিনি প্রচুর পরিমাণে বই পড়তেন ও অন্যদের পড়াশুনা এবং বই পড়ার জন্য উৎসাহ দিতেন।
তিনি ছিলেন জম্মসূত্রে সাংসারেক, কিন্তুু শেষ পর্যন্ত ১৯৫২ সালে আত্নীয় স্বজন এবং আশেপাশের মানুষের অনুপ্রেরণার ফলে সাংসারেক ধর্ম ছেড়ে ত্রাণকর্তা হিসাবে যীশুকে গ্রহণ করে ফলে খ্রিষ্টান হয়ে যান। যেমন সমাজের জন্য কাজ করেছেন তেমনি খ্রিষ্টান ধর্মের জন্যও কাজ করেছেন। তিনি শিশিলিয়া দারুর সাথে বিবাহে আবদ্ধ হন ১৯৫৬ সালে। তিনি তিন মেয়ে এবং দুই পুত্রের জনক।বর্তমানে মেয়ে ছেলে সবাই যার যার অবস্থান থেকে প্রতিষ্ঠিত। তিনি শুধু আদিবাসীদের অধিকারে জন্যই সংগ্রাম করেননি একি সাথে ডাক্তার ছিলেন।তখনকার সময়ে আশাপাশে এলাকায় কোন ডাক্তার ছিল না ফলে অনেক নারী পুরুষ বিভিন্ন রোগে শোকে মারা যেত, সেই কারনে তিনি নিজে নিজে হোমিপ্যাথিক এবং এলোপ্যাথিক শিখে নেন এবং দুরদুরান্ত থেকে চিকিৎসার জন্য রোগীরা সব সময় ভিড় করতো,প্রচুর পরিমাণে রোগী আসতো।এমনি ভাবে তার কাজের নাম আশাপাশে এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে তিনি একজন সবার কাছে জনপ্রিয় মানুষ হয়ে উঠেন।
জানা যায়,পা রাজা পরেশ চন্দ্র মৃ প্রকাশে প্রতিবাদ শুরু করে ১৯৫২ সালে, যখন পাকিস্তান সরকার জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের সাথে সাথে আদিবাসীর একমাত্র আয়ের উৎস ঝুম চাষ বন্ধ করে দেয়।তার পর হঠাৎ করে ১৯৫৬ সালে আবিমার আদিবাসীদের জমি সরকার ধনী ব্যক্তিদের কাছে নিলামে বিক্রি করে দেয়।ঝুম চাষ বন্ধ জমি নিলাম এই সমস্ত বিষয় নিয়ে আদিবাসীদের মনে প্রচন্ড রকম ভাবে ক্ষোভ জমতে থাকে এবং তীব্র প্রতিবাদ করে। একি বছরে আদিবাসীদের উপর বিশাল বড় আঘাত আসে,১৯১২ থেকে১৯১৯ সাল পর্যন্ত আদিবাসীদের রেকর্ডকৃত সিএসসি জমি খাস জমি হিসাবে ঘোষণা করে এবং বন বিভাগের আওয়তায় নিয়ে আসে।ফলে আদিবাসীদের স্বাভাবিক জীবন বিঘ্ন ঘটে ও নানান ভাবে হয়রানি শিকার হতে হয়।এই সব দেখে পা রাজা পরেশ চন্দ্র মৃ সহ অন্যন্য আদিবাসী নেতা সরকারের কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করে সাময়নিক সমস্যাগুলো সমাধান করে।সাময়নিক সমাধানের পরে পরেই আদিবাসীদের উপর আবার আঘাত আসে,সরকারের লোক ১৯৬১ সালে আদিবাসী ১২-১৫টি গ্রাম নিয়ে প্রায় ৪০ বর্গমাইল এলাকা যোগ করে ইকোপার্ক গড়ে তোলা ঘোষণা দেন, মৌখিক ভাবে।তখন আদিবাসী নেতারা তীব্র প্রতিবাদ জানায়।সবার আগে যিনি সব সময় অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেন তিনি পা রাজা পরেশ চন্দ্র মৃ।
তার উদ্যোগে ১৯৬২ সালে আদিবাসীদের অধিকার আদায়ের জন্য এবং সংগ্রাম আন্দোলন জোরদার করার জন্য একটি সংগঠন গড়ে তুলেন।সেটির তখন নাম ছিল "জলছত্র জয়েনশাহী আদিবাসী ঋণদান সমবায় সমিতি"যা বর্তমানে নাম পরিবর্তন হয়ে এখন"জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদ"। কিছুদিন নিরব থাকার পর সরকার আবার ১৯৬৭-৬৮ এবং ১৯৮০ সালে গ্রাম উচ্ছেদের নোটিশ দেন এবং ক্ষতিপূরণে আশ্বাস দেন।নানা ভাবে পা রাজা পরেশ চন্দ্র মৃ কে সরকার প্রলোভন দেখিয়েছিল,কিন্তুু তাতে তিনি সাড়ে দেননি, যদি তিনি সাড়া দিতেন, তাহলে আবিমা আদিবাসীর অস্তিত্ব থাকতো বলে মনে হয় না।
পরিশেষে, রোগব্যাধি নিয়ে ১৯৯৮ সালের ৭মার্চ এই মহানেতা মৃত্যুবরণ করেন।তার সস্তত কাজ আমাদের প্রত্যেকের জীবনে এক আলোচ্য বিষয়।তার মৃত্যুর আমাদের জন্য এক বিশাল বড় ক্ষতি,তার অসমাপ্ত কাজ আমাদেরি করতে হবে।এমন নেতা আর জম্ম নেবে কী না জানি না?তবে তার কাজের মাধ্যমে এক জীবন্ত প্রতীক হিসাবে আমাদের আন্দোলন সংগ্রামে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে।
এই মহানেতাকে জানাই "লাল সালাম"।
No comments