চনগিপ্পা মিদ্দি গয়রা গানথাপ-এর কথা


চনগিপ্পা মিদ্দি গয়রা গানথাপ-এর কথা





অনেক দিন আগের কথা।তখন আমাদের আচ্চু আম্বিরা পাহাড়ে জুম চাষ করতেন।সেই জুমে ক্ষেতের একটু দূরে দূরেই বড় গাছের উপর দুই তিনজন ঘুমাতে পারে এমন ছোট ক্ষেত পাহারা ঘর বানাতন।যাকে গারো ভাষায় বোরাং বলা হয়।সেই ক্ষেত পাহারা ঘরে দিনে একদল আর রাতে আরেকদল পাহারায় থাকতেন।একদিন রাতে আচ্চু আম্বি দুজনে ক্ষেত পাহারা ঘরে বসে নানান বিষয়ে গল্প করছেন।আচ্চু খাৎত্থা রেংসি(কথা মালা)থেকে গল্প শোনাচ্ছেন।পরিষ্কার চাঁদনি রাত।সবকিছুই স্পষ্ট দেখা যায়।
এক সময় আচ্চু গল্প বলা থামিয়ে অবাক হয়ে একদিকে তাকিয়ে আছেন।আম্বিকেও ইশারায় দেখিয়ে দিলেন।তারা দেখলেন এক লোক ঝুংগা ভরতি তুলা পিঠে করে নিয়ে যাচ্ছে।লোকটি কিছু দূরে দাঁড়িয়ে ডাক দিল-কেউ কি বুরাং ঘরে আছো?আচ্চু উত্তর দিলেন-আছি,আমরা স্বামী-স্ত্রী আছি।লোকটি আচ্চুদের বোরাং  ঘরে আসল আর খাবার থাকলে কিছু খেতে চাইল।


আম্বি সকালের নাস্তার জন্য বিন্নি ভাত রেধে রেখেছিলেন।তাই তারা তাকে খেতে দিলো।লোকটি খেয়ে খুশি হয়ে বলল,সে চনগিপা মিদ্দি গয়রা গানথাপ। সে মিদ্দিদের জন্য খিলগ্রো সংগ্রহ করছে।আম্বি তার কাছে কিছু তুলা চাইল আর তুলা থেকে কীভাবে সুতা বের করতে হয় তা জানতে চাইল।



মিদ্দি আম্বির জন্য তুলা দিল আর কীভাবে তুলা থেকে সুতা তৈরি করতে হয় তা শিখিয়ে দিল।তুলার নাম খিলগ্রো।তুলাটি এইরুপ,এই তুলার সুতা গুটানো অবস্থাতেই থাকে।প্রাকৃতিকভাবেই এই তুলার সুতা গুটানো অবস্থাতেই জম্ম হয়।একটি গুটানো তুলাতে একটিমাত্র বীজ আছে।তুলার সুতার মুখে ধরে একজন আসতে করে টানতে হবে,সঙ্গে একটি মাকড়সা ধরে মাকড়সার পিছনের সুতার সাথে মিলিয়ে আর একজন সুতা মিলাবে। গারো পাহাড়ে এই জাতের মাকড়সা পাওয়া যায়।একজন তুলা ধরে থাকবে।এই মোট তিনজন মিলে সুতা তৈরি করবে।মাকড়সার সুতা সঙ্গে সঙ্গেই শুকিয়ে যাবে আর এই তুলার সুতাও শক্ত হবে।এই সুতা দিয়ে তুমি সুন্দর সুন্দর কাপড় বুনবে।
চনগিপা মিদ্দি গয়রা গানথাপ চলে গেলেন আর আম্বির জন্য রেখে গেলেন অমূল্য সম্পদ।পরবর্তী সময়ে সেই খিলগ্রো তুলা গারো পাহাড়ে ব্যাপক বিস্তার লাভ করে।এই তুলার সুতা দিয়ে সুক্ষ্ম কাপড় বুনা যায়।কালক্রমে সেই তুলা সুসং রাজাদের মাধ্যমে বাঙালিদের কাছে যায়।এই তুলা শুধু গারো পাহাড়ে জম্মে।অন্য কোথাও এর চাষ করা যায় না।বাঙালি তাত কারিগররা গারোদের কাছ থেকে এই তুলা থেকে সুতা বের করার কায়দা শিখে নেয়।পরে তারা এই তুলার সুতার সাহায্যে কাপড় বুনে কাপড়ের নাম রাখে মসলিন কাপড়।


গারোরা মিদ্দির নাম অনুসারে কাপড়ের নাম রাখে গানা গানথাপ। ঢাকার বাঙালি মসলিন কাপড়ের কারিগরা এই তুলা মাটির হাঁড়ি পাতিল ও লবণের বিনিময়ে গারোদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে যেতেন।এই প্রজাতির তুলা গাছ এখন বিলুপ্ত। দিল্লির মোঘল আমল পর্যন্ত এই তুলার চাষ গারো পাহাড়ে হতো।



গারোরা এই তুলা কোনো বাজারেই বিক্রি করতে পারতো না।সুসং দুর্গাপুরের রাজাদের লোক সেই তুলা ছিনিয়ে নিয়ে যেতো।তুলার কোন দাম দিতো না।মূল্য যা দিতো তাও যৎসামান্য ছিল,নামমাত্র। সুসং রাজাদের অত্যাচারেই এই তুলার চাষ গারো পাহাড় থেকে কাল ক্রমে বিলীন হয়ে যায়।



গারো লোককাহিনী
ইগ্নাসিউস দাওয়া

No comments

Theme images by saw. Powered by Blogger.