কিংবদন্তি আগ্রং রাজা




কিংবদন্তি আগ্রং রাজা

সন্ত্রাসী মিল্লাম জাককে সোমেশ্বর পাঠক বিষ প্রয়োগে হত্যা করে সুসং রাজ্য দখল করার পর সুসং এলাকায় আর কোন সন্ত্রাসী কার্যকলাপ হয় নাই।কিন্তুু একশ বছরের পর আবার একজন গারো সন্ত্রাসী মাথাচারা দিয়ে উঠে।তখন সুসং রাজ্য শাসন করত সোমেশ্বর পাঠকের ছেলে গুণাকর পাঠক।

এই সন্ত্রাসী নাম আগ্রং নকমা।সে শতাধিক পরিবারকে শাসন বা পরিচালনা করতো।সে গেরিলা কায়দায় যুদ্ধ করতে খুব পটু ছিল।গ্রামের সব পুরুষই শক্তিশালী ও যোদ্ধা ছিল।সবাই গাছ-গাছালীর ভেষজ ঔষধ বিদ্যা ভাল জানতো।বিশেষ করে চুরি বিদ্যার মন্ত্র ও দ্রব্যগুণের ব্যবহার ভাল জানতো।আগ্রং নকমা ও তার দল দুইটি গ্রাম ব্যবহার করতো।একটি গভীর জঙ্গলে স্থায়ী গ্রামে অন্যটি পাহাড়ের পাদদেশে অস্থায়ী গ্রাম।স্থায়ী গ্রামে থেকে পাহাড়ে জুম চাষ করতো।আর অস্থায়ী গ্রামে থেকে দূরের বাঙালি গ্রামে এসে লুটপাট করতো।

রাজা গুণাকর পাঠকের তেমন সৈন্যবল ছিল না।আর রাজার সৈন্যরা এই আগ্রং নকমাকে আক্রমণ করতে সাহস করতো না।রাজা দুই বার আক্রমণ করে ব্যর্থ হয়ে অন্যপথ বেছে নিলেন। তার পিতার মতই বিষ প্রয়োগে মারতে চেষ্টা করলেন।কিন্তুু কোন বাঙালি তাদের গ্রামে ঘেঁষতে পারত না বা প্রবেশ করতে সাহস করতো না।


রাজা একবার যুদ্ধ ব্যবসায়ী সৈন্য এনে এই আগ্রং নকমাকে আক্রমণ করে ও তার গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে তাদের পাহাড়ের গভীরে তাড়িয়ে দেয়।আগ্রং নকমা সেই যুদ্ধে যখম হয় ও রাজার উপর ভীষণ ক্ষেপে যায়।রাজাকে কীভাবে হেস্ত নেস্ত করা যায় তার চিন্তা ভাবনা করতে থাকে।তিন চারজন চুরি বিদ্যায় পারদর্শীকে গুণাকরের ঘরবাড়ি রাস্তা ঘাট কোথায় কী কী আছে তা জানার জন্য পাঠিয়ে দিল।উদ্দেশ্য গুণাকরকে হেস্ত নেস্ত করা। গুণাকরের ক্ষতি করা। যুদ্ধের প্রতিশোধ নেওয়া।

এক রাতে চোরের দল এসে রাজার ঘরবাড়ি,রাস্তা ঘাট,কোথায় ধানের গোলা ঘর,কোথায় কোথায় পাহাড়াদাররা থাকে,কীভাবে সহজে রাজবাড়ি প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে পারবে সব জেনে আসল।ভেবে চিন্তে এক রাতে আগ্রং নকমা এই চোরের দল নিয়ে রাজবাড়িতে হানা দিল।

প্রথমেই প্রহরীদেরকে দ্রব্যগুণ দিয়ে অচেতন করে বেঁধে রাখলো।আগ্রং নকমা রাজবাড়ি সবকিছু ভাল করে দেখে নিল।কিন্তুু রাজাকে হেনন্থা করার মতন কিছুই দেখল না।অবশেষে একটি জিনিস দেখল এবং এইটাই তার মনপুত হল।সেই সময় রাজার পায়খানা ঘর বর্তমানের পায়খানা ঘরের মতন ছিল না।পায়খানা ঘর উচু ছিল।নিচে কাঠের ঠেলা গাড়ির উপর মাটির চাড়ি বসানো থাকতো। রাজা ও তার পরিবারবর্গ এই চাড়ির মধ্যেই পায়খানা করতেন।চাড়ি ভরে গেলে মালি বা মেথর এসে সেই ঠেলা গাড়ি বের  করে অনেক দূরে ময়দানে ফেলে আসতো।আর একটা খালি চাড়ি ঠেলা গাড়িতে করে সেই আগের জায়গায় বসিয়ে আসতো।

আগ্রং নকমা এই চাড়ি ভর্তি পায়খানার ঠেলা গাড়ি বের করে রাজার বাড়ির উঠানে আনলো।তারপর রাজার সমস্ত উঠানে ছড়ায়ে ছিটায়ে ঢেলে আসলো।দুর্গন্ধে রাজ বাড়িতে থাকা অসম্ভব হয়ে পরলো।অন্যদিকে চোরেরা গোলা ঘরের দরজা ভেঙ্গে বস্তা ভর্তি চাউল নিয়ে আসলো।

রাজা সকালে উঠে তার উঠানের এই অবস্থা দেখে হতবাক।প্রহরীকে ডাকতে গেলে দেখে প্রহরীর হাত পা বাঁধা।অন্যন্য রাজ কর্মচারীরা এসে খবর দিল গোলাঘর খোলা ও চাউলের বস্তা চুরি হয়ে গেছে।আগেকার দিনে রাজারা তাঁতের বোনা পাঠের বস্তা ব্যবহার করতেন।মেশিনে বোনা চটের মতন তেমন ঠাসা বোনা ছিল না।বস্তা ঘাড়ে বহন করলে দু একটা চাউল বের হতো।রাজা মাটিতে চাউলের পড়ে থাকা চিহ্ন দেখে বুঝতে পারলেন আগ্রং নকমার এই কাজ।মেথর এসে উঠান পরিষ্কার করলেও সারা রাজবাড়ি গন্ধে ভরে রইল।

দু এক সপ্তাহ টরে আবার সেই একইভাবে উঠানে ময়লা পায়খানা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল।এইভাবে রাজাকে হেস্ত নেস্ত করতে লাগলো।আর নিজেকে আগ্রং রাজা বলে দাবি করতে লাগলো।সুসং রাজা পুনরুদ্ধারেরর জন্য রাজাকে হুমকি দিতে লাগলো।


রাজাও বসে নেই। কীভাবে আগ্রং নকমাকে মারা যায় সেই উপায় খুঁজতে লাগলেন।আগ্রং নকমাকে মারতে না পারলে এইভাবে রাজ বাড়িতে ময়লা দুর্গন্ধ ছড়াবেই।রাজা রাজবাড়িতে পাহাড়াদারদের সংখ্যা বাড়িয়ে দিলেন।তবু সেই একই অবস্থা। সবচেয়ে অসুবিধা এই আগ্রং নকমা রাতের অন্ধকারে তার কুকর্ম পরিচালনা করতো।কারণ রাতের অন্ধকারে স্পষ্ট দেখার ঔষধি গাছ আগ্রং নকমা জানতো।হাতি তাড়ানোর ঔষধ ও অন্যন্য গাছ-গাছালীর দ্রব্যগুণ  জানতো বলেই রাজা হাতি দিয়েও তাকে মারতে পারতেন না।হাতি আগ্রং নকমাকে দেখলেই ভয়ে পালিয়ে যেত।রাজা রাজবাড়ি থেকে অনেক দূরে বড় বাগানে বড় বড় গাছের মধ্যে হাতি বেঁধে রাখতেন।


একদিন আগ্রং নকমা তার দলবল নিয়ে এই বাগানে এসে রাজার সমস্ত হাতির বাধন মুক্ত করে জঙ্গলে তাড়িয়ে দিল।এইভাবে আগ্রং নকমা নানাভাবে সুসং রাজাকে অত্যাচার করতে লাগলো।এই লজ্জাকর কথা রাজা অন্য কাউকে জানাতে পারছেন না।

আগ্রং নকমা ভিন্ন ভিন্ন কায়দায় নানাভাবে রাজা গুণাকরকে অত্যাচার করতে লাগলো।আগ্রং নকমা একদিন অনেক গারো যোদ্ধা নিয়ে সুসং রাজবাড়ি আক্রমণ করলো।রাজা অপ্রস্তুুত ছিলেন।প্রাণের ভয়ে রাজা দক্ষিণের গ্রামে পালিয়ে গেলেন।হাতির পিঠে চড়ে রানিরা ধন দৌলত, দাস দাসী নিয়ে দূরের গ্রামে পালিয়ে গেলেন।গারোরা হাতির জন্য ভয় পেত না। বরং হাতিরা গারোদেরকে দেখলে ভয়ে চিৎকার করত ও যে যেদিকে পারে দৌড়ে পালাতে।

আগ্রং নকমা সুসং রাজ্য উদ্ধার করে নিজেকে আগ্রং রাজা বলে ঘোষণা করলেন।সবাই তাকে আগ্রং রাজা বলে ডাকতে লাগলেন।এই দিকে রাজা রাজধানী উদ্ধারের জন্য শত শত যোদ্ধা সংগ্রহ করলেন।একমাস পরে নিজ রাজ্যের যোদ্ধা দিয়ে সুসং রাজ্যের রাজধানী পুনরুদ্ধার করলেন।চারিদিকে থেকে শত শত লোক আআক্রমণ করতে দেখে গারোরা উওর দিকে পাহাড়ে দ্রুত পালিয়ে গেল।


রাজা রাজধানী উদ্ধার করেই রাজ বাড়ির উত্তর দিকে গভীরভাবে খাল খননের মননিবেশ করলেন।যাতে আগ্রং রাজা পুনরায় সহজে তার রাজধানী দখল করতে না পারে।আজও সেই খাল খননের চিহ্ন দেখা যায়।

অনেক দিন পর আগ্রং রাজা তার চোরের দলকে আবার রাজ বাড়িতে পাঠালেন।চোরেরা দেখে সব পরিবর্তন হয়েছে,চারিদকে পাহাড়ার ব্যবস্থা হয়েছে।এইবার আগ্রং রাজা অন্য একটা বুদ্ধি বের করলেন।পাহাড়ে এক প্রকার বিষাক্ত বিছু পাওয়া যায়।গারো ভাষায় একে "মাংখ্রাম"বলে।এই বিছু পাহাড়ের মাটিতে গর্তে ও বিশেষ বিশেষ জায়গায় পাওয়া যায়।আগ্রং রাজা এই বিছুকে খুজে খুজে বাঁশের চুংগায় সংগ্রহ করে চোরদের সাহায্যে প্রত্যেক পাহাড়াদারের ঘরে রাতের অন্ধকারে ছেড়ে আসলো।

আগ্রং রাজা খুব গরমের দিনে তার দলবল নিয়ে সিমসাং নদীতে বড় ডোবায় ডুব দিয়ে মাছ ধরতো।মাছ ধরা তার খুব সখ ছিল।বাঙালি জেলেরাও সময় সময় ডোবায় জাল ফেলে মাছ ধরতো।একদিন এই জেলেরা আগ্রং রাজাকে ডোবায় ডুব দিয়ে মাছ ধরতে দেখলো।তারা এই খবর রাজাকে জানালো।রাজা সমস্ত জেলেদেরকে ডেকে আনলেন।তাদের সাথে বুদ্ধি পরামর্শ করলেন।রাজা বললেন,কোনদিন যদি এই সুযোগ আবার আসে তবে তোমরা সবাই মিলে একজনের পর একজন তার উপর জাল ফেলবে।যেন সে আর পানি থেকে উঠতে না পারে।জাল ফেলেই দ্রুত নৌকা চালিয়ে চলে আসবে,যাতে তোমাদেরকে তার দল ধরতে না পারে।তোমাদের জালের দাম আমি দ্বিগুণ করে দেব।


জেলেরা সহজ সরল ও ভীরু প্রকৃতির।তারা রাজার এই প্রস্তাব কার্যকরী করতে সাহস পেল না।রাজা জেলেদেরকে এই বলে সাহস দিলেন যে,তোমরা প্রত্যেক নৌকায় দুটো করে রামদাও সঙ্গে রাখবা।যদি বিপদ আসে তবে অস্ত্র ধরবে।ভয়ের কিছু নেই।রাজ্য রক্ষা করতে হলে তোমাদেরকে এইটুকু কাজ করতে হবে।রাজার এই ষড়যন্ত্রেরর কথা গারোরা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারল না।জানলে একজন জেলেও ঐ ডোবা থেকে ফিরে আসতে পারতো না।

রাজার কথা মতো জেলেরা একদিন এই সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে গেল।আগ্রং রাজা ও তার দল ডোবায় ডুব দিয়ে মাছ ধরছে।যেই আগ্রং রাজা মাছ ধরতে জলে ডুব দিয়েছে অমনি জেলেরা একজনের পর একজন তার উপর জাল ফেলে নৌকা চালিয়ে পালিয়ে গেল।আগ্রং রাজার সঙ্গীরা এই কান্ড দেখে হতবাক হয়ে গেল।জেলেরা সব নৌকায় থাকায় একজনকেও ধরে রাখতে পারলো না।এই ডোবায় আগ্রং রাজাকে মেরে ফেলার জন্য আজও এই ডোবার নাম আগ্রং ডোবা বা আগ্রংওয়ারি নামে নামকরণ করা হয়েছে।ডোবাটি রানিখং মিশনের দেড় কিলোমিটার উত্তর পূর্ব দিকে অবস্থিত।

গারোদের সুসং রাজ্য উদ্ধারের সম্ভাবনাময় ব্যক্তির এইভাবে মৃত্যু হওয়ায় গারোদের আশা আকাক্ষা বিলুপ্ত হয়ে গেল।গারোরা এই ব্যক্তিকে নিয়েই গারোদের সুসং রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতো।আজও শুধু আগ্রং রাজা গারোদের মাঝে কিংবদন্তি হয়ে রইলো।


গারো লোককাহিনী
ইগ্নাসিউস দাওয়া

প্রকাশিত-থকবিরিম।

No comments

Theme images by saw. Powered by Blogger.