সাক্ষাৎকার;জনপ্রিয় তরুণ আদিবাসী ইউটিউবার নীল নন্দিতা রিছিল।।জাডিল মৃ।।
এই করোনাকালীন সময়ে অনলাইনের মাধ্যমেই সাক্ষাৎকার দিয়েছেন জনপ্রিয় ইউটিউবার ও আদিবাসীদের অনুপ্রেরণার আরেকটি নাম 'নীল নন্দিতা রিছিল'।যিনি গারো আদিবাসীদের মধ্য থেকে এক মাইফলক ছুঁয়েছেন। যা এখন অন্যান্য পথিকদের পথ দেখাচ্ছেন।তিনি নিজের জীবনবোধ সম্পর্কে, কাজ সম্পর্কে,বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে এবং আরো নানাবিধ বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন।সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাডিল মৃ..
জাডিল মৃ:আপনার এই করোনাকালীন সময়ে দিনকাল কেমন যাচ্ছে?
নীল নন্দিতা রিছিল: করোনার সময় পুরোটাই বাড়িতে সময় কাটছে । মোটামুটি নির্ভেজাল একটা সময় কাটাচ্ছি পরিবারের সাথে। যেহেতু আমি ঢাকায় পুরো বছরটা'ই থাকি। তাই বাড়িতে আসা হয় কম । এইবার করোনার জন্য অনেক মাস ধরে বাড়িতেই আছি। বলা যায়, পরিবারের সাথেই বেশি সময় ব্যয় করছি , যেহেতু এখন বাইরে বের হওয়াও নিষেধ।
এ ছাড়া বাড়িতে বসেই আমার ইউটিউবিং এর কাজ চালাচ্ছি।
জাডিল :বর্তমানে কী কাজ নিয়ে ব্যস্ত?
নীল :আপাতোত খুব বেশি ব্যস্ত সময় পার করছি না। তাই ধীরে সুস্থেই কাজ করছি ।আবার ভ্লগ তৈরির দিকে মনযোগ দিচ্ছি। করোনায় আসলে সেভাবে ভ্লগের কাজ করতে পারিনি। আর এত মাস ধরে বসে থাকায় সাবধানে কিভাবে আর কোথায় গিয়ে ভ্লগ তৈরী করা যায়। সেগুলো নিয়েই কাজ করছি আসলে ।
ছবি-সংগৃহীত। |
জাডিল : ৫০ হাজার সাবস্ক্রাইবার পূর্ণ করলেন, অনুভূতি কেমন লাগছে?
নীল: ৫০ হাজার সাবস্ক্রাইবার পূর্ন হলো তাতে অবশ্যই আনন্দ লাগছে । তবে ১ হাজার হওয়ার সময় যেমন লেগেছিলো তার চেয়ে একটু হলেও কম আনন্দ লাগছে ।
কারণ, ৫০ হাজার হতে আমার খুব বেশি সময় লাগেনি। কিন্তু ১ হাজার পেতে আমাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে । আর এখন যাই আছে সবই সেই সময়কার কষ্টের'ই ফল বলে আমার মনে হয় । এখনো যে কষ্ট করি না তা না, তবে এখন অনেকটাই পরিচিত পাবার কারণে সাবস্ক্রাইবার নিয়ে এতো'টা ভাবতে হয় না ,এই আর কি!
জাডিল: বাংলাদেশী গারো কিংবা আদিবাসী নারী হিসাবে অনুপ্রেরণা জায়গা তৈরি করেছেন। কেমন লাগছে?
নীল: বাংলাদেশী গারো নারী হিসেবে অনুপ্রেরণার জায়গা কতটুকু তৈরী হয়েছে সবার মাঝে সেটা আসলে আমি জানি না । তবে অনেকেই হয়তো আমার কাজ দেখে ইউটিউবে আসার জন্য স্বপ্ন দেখছে বা কাজ করতে আগ্রহী হচ্ছে। সেই দিক থেকে ভাবলে সত্যি ভালো লাগছে যে, অন্তত নিজের জন্য করার পাশাপাশি অন্যদেরও আমার কাজ দেখে এই প্লাটফর্মে আসার মতো কিছু কাজ হয়তো করতে পারছি। যার জন্য আগের তুলনায় এখন গারো ইউটিউবার দিন দিন বাড়ছে ।
জাডিল:ইউটিউব ছাড়াও কী করতে ভালোবাসেন ও সামনে নতুন চ্যানেল আসবে কি?
নীল: ইউটিউবে কাজ করা ছাড়াও আমি ছবি তুলতে ভালবাসি ,ফটোগ্রাফিটাও আমার ইউটিউবের মতোই প্রিয় কাজ । আমি ইউটিউবে আসার অনেক আগে থেকেই ফটোগ্রাফির প্রতি আকর্ষিত ছিলাম। এখনো আছি । সেই জন্য ফটোগ্রাফি রিলেটেড যে কোন কাজ আমি মনযোগ দিয়ে করি এবং এখন পর্যন্ত অনেক ইভেন্টেই প্রফেশনালি কাজ করেছি। ইচ্ছা আছে সামনেও করবো ।
আর নতুন চ্যানেল ,সামনে একটা আসবে । ইচ্ছা ছিলো এই জুলাই মাসেই সেটার প্রথম ভিডিও পাবলিশড করবো। তবে করোনার কারণে এখনো করে উঠতে পারিনি। তবে শীঘ্রই সেটা করে ফেলবো।
জাডিল: ইউটিউব করতে গিয়ে কোন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন কি?এখনো সমস্যা হয় কিনা?
নীল: ইউটিউবিং করতে গিয়ে সমস্যায় তো পড়েছি। সেটা একেক দিক থেকে একেক রকম সমস্যা ছিলো। যেমন, প্রথম দিকে গারো আচিক ভাষা ( ইন্ডিয়ার গারো'রা যেটা বলে) ভালোভাবে বলতে পারতাম না দেখে প্রচুর সমালোচনার শিকার হতে হয়েছে । এরপর সেখান থেকে আস্তে আস্তে শিখতে হয়েছে । এছাড়াও দেখাগেছে ভিডিও তৈরী করতে গিয়ে কখনো ফোন নষ্ট হয়ে গেছে আবার কখনো এডিটিং সফটওয়্যার কাজ করছে না এইরকম টেকনিক্যাল অনেক সমস্যায় পড়েছি। সেগুলো আসলে বড় কোন সমস্যা না ,প্রতিবারই সেগুলো ওভারকাম করেছি।
এইসব সমস্যা ছাড়া এখনো সে রকম কোন বড় সমস্যায় আসলে পড়িনি। আমার ইউটিউবিং লাইফে সব কিছুই সুন্দর ভাবে এগোচ্ছে, এখন পর্যন্ত। তবে প্রয়োজনীয় গ্যাজেট না থাকায় মনের মতো ভিডিও তৈরী করতে পারি না। শুধু মাত্র মোবাইল দিয়ে সব কাজ করতে হয়।এটা একটা বড় সমস্যা । আশা করি সামনে এ সমস্যাও ওভারকাম করবো।কাজ করতে থাকি যা আছে তাই দিয়েই।
জাডিল: নতুন যারা ইউটিউবে আসবে তাদের জন্য কোন পরামর্শ?
নীল: আমি নিজেও নতুন মাত্র দুই বছর হবে ইউটিউবে কাজ করছি। তারপরও এই এক্সপেরিয়েন্স থেকে যদি আমার পরে আসা ইউটিউবার'দের জন্য কিছু বলতে চাই তাহলে বলবো ,যা আছে তা নিয়ে সততার সাথে কাজ করলে ইউটিউব কখনো নিরাশ করবে না । যে যত সৎ থেকে পরিশ্রম করবে সে তার ফল ততই পাবে । বারবার সৎ শব্দ'টা ব্যবহার করছি এই জন্য যে, ইউটিউবে অটো সাবস্ক্রাইবার ,অটো ভিউস বা সাব ব্যাক করে অনেকেই দ্রুত সব অর্জন করতে চায় ,তাদের জন্য বলছি যে ইউটিউবকে ফাঁকি দিতে গেলে নিজেকেই শূন্য হাতে ফিরতে হবে ।
তাই শুধু মাত্র কাজ ,কাজ আর কাজ, ব্যাস। এইটা ছাড়া আর কিছু ভাবা যাবে না । তা ছাড়া গারো ইউটিইবার'দের জন্য যদি বলি তাহলে নিজস্ব ভাষায় ভিডিও বানান সবাই। কেউ দেখুক না দেখুক ,ভিউস আসুক বা না আসুক মনে একটা শান্তি পাবেন ।
সেই সাথে ইউটিউবে এসে আর্নিং টাকে ফোকাস করা একদমই বাদ দিতে হবে। আর্নিং এখান থেকে তখনই হবে যখন আপনি সব ভুলে শুধু কাজের দিকে ফোকাস করবেন । এ ছাড়া কিছুই হবে না।
জাডিল: ইউটিউব শিক্ষার্থীদের ইনকামের পথ হতে পারে কিনা?
নীল: হ্যাঁ। ইউটিউব আমাদের মতো অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের জন্য কিছুটা হলেও ইনকামের উপায় হতে পারে । কারণ এখানে পড়াশোনার পাশাপাশি কাজ করা ,সেখান থেকে ইনকাম আসা একটা আলাদা ব্যাপার । আর শুধু ইউটিউবে কাজ করে সেটাকে প্রথম ইনকাম সোর্স ভাবা আরেক ব্যাপার ।
আমরা শিক্ষার্থীরা ইনকামের জন্য তো এখানে আসবো না কিন্তু যদি পড়াশোনার পাশাপাশি ইনকাম হয় ব্যাপারটা মন্দ না । আর সেটা সম্ভব কারণ আমি তাই করছি। আমার প্রথম ইনকাম সোর্স ইউটিউব না কিন্তু এখান থেকে একটা ইনকাম আসছেই এক/দুই মাস অন্তর অন্তর। যা দিয়ে অনায়াসেই আমি পড়াশোনা-সহ বাকি কিছু খরচও বহন করতে পারি ।
তাই বলা যায় যে এটা শিক্ষার্থীদের জন্য ভালো একটা প্লার্টফর্ম। যেখানে নিজেকে দেখানোর বা নিজের কাজের মাধ্যমে ইনকাম করার ।
জাডিল : বাংলাদেশের আদিবাসীদের একটা বড় প্লাটফর্ম হতে পারে কী ইউটিউব!এবং কিভাবে?
নীল: বাংলাদেশে এখন সার্চ করে দেখলে আদিবাসী অনেক ইউটিউব চ্যানেলই পাওয়া যাবে । আদিবাসী ধরে যদি বলি তাহলে চাকমাদেরও বড় বড় চ্যানেল আছে। তবে আমি শুধু গারোদের কথায় বলতে চাই যা আমার গন্ডির মধ্যে পড়ে ।
আমরা চাইলেই ইউটিউবেও গারোদের বড় ইউটিউবার কমিউনিটি গড়তেই পারি । কারণ আমার চারপাশে এই পেশায় আসার বা এই প্লার্টফর্মে আসার অনেক যোগ্য গারো ছেলে মেয়েই আছে। তবে তারা এখনো এখানে আসার জন্য কিছু ভাবনা চিন্তাও করেনি। হয়তো ধীরে ধীরে সবাই আসবে। যখন বুঝতে পারবে যে ইউটিউবও একটা কাজের জায়গা। এখানে শুধু মজার ভিডিও দেওয়া হয় না ,চাইলেই যে যার প্রতিভা অনুযায়ী এখানে কাজ করতে পারে ।
ছবি-সংগৃহীত। |
জাডিল: "বিডি গারো প্রোডাকশন", এর সাবক্রাইবার বাংলাদেশের চাইতে ইন্ডিয়ান সাবক্রাইবার বেশি কেন?
নীল: 'বিডি গারো প্রোডাকশন', একটি সম্পূর্ন গারো ভাষায় কনটেন্ট তৈরী করা চ্যানেল। তাই এই চ্যানেলে শুধু গারোদের'ই যাতায়াত রয়েছে। তার মধ্যে ইন্ডিয়ান গারোরা রয়েছে সিংহভাগ। এটা হতে পারে সেখানে গারোরা বেশি বসবাস করে আর তাঁরা ইউটিউবেও গারো ভিডিও বেশি দেখে । সে দিক থেকে বাংলাদেশী হিসাবে আমার চ্যানেলেই প্রথম গারো ভাষায় ভ্লগ সহ যাবতীয় ভিডিও দিতে শুরু করার পর থেকে তাদের সংখ্যায় বেশি । তারা পছন্দ করে গারো ভাষায় ভ্লগ। আমি আমাদের বাংলাদেশী গারোদের নানা এলাকার ভিডিও দেয়, তারা দেখে । নাচ ,গান সবই তারা গারো ভাষায় পছন্দ করে এবং প্রচুর পরিমাণে আমাকে সাপোর্ট করে যে আমি বাংলাদেশে থেকে গারো ভাষায় কাজ করছি।
বাংলাদেশী গারোরা তাদের তুলনায় কম এটার কারণ হতে পারে যে, যা কিছু ভ্লগে দেখানো হয় সেসব তারা আগে থেকেই জানে বা দেখেছে। কিংবা গারো ভাষায় ভ্লগ বেশি সময় হয়তো দেখতে পছন্দ করে না অথবা অন্য কারণ থাকতে পারে । তবে একেবারেই যে দেশের গারোরাও কম, সেটাও বলা যাবে না। কারণ এখন প্রায় যেখানেই যায় সবাই বলে যে তাঁরা আমার ভিডিও দেখে এবং দেখেছে । তাই আমার মতে এখন বাংলাদেশেও বিডি গারো প্রোডাকশন মোটামুটি সবার কাছে পৌঁছাচ্ছে ,সবাই দেখছে । এই তো....
জাডিল-করোনাকালে ভালো থাকবেন,সুস্থ্য থাকবেন।ব্যস্ত সময়ে সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য, ধন্যবাদ।
নীল:হ্যাঁ। এই পরিস্থিতে আপনিও ভালো থাকেন আর বিডি গারো প্রোডাকশনের সাথে থাকার জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ। সেই সাথে বাংলাদেশের গারো এবং ইন্ডিয়ান গারো প্রত্যেক কে ধন্যবাদ যারা আমাদের এই ৫০ হাজার পরিবারের সাথে যুক্ত হয়েছেন/রয়েছেন।
No comments