করোনাকালে তরুণ আদিবাসী শিক্ষার্থীদের ভাবনা।।পর্ব-২।।
ছবি:সংগৃহীত। |
করোনা মহামারী হয়ে দেশের পরিস্থিতি যখন তাল-মাতাল তখন স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়। আর তাতেই আমি বাড়িতে পাড়ি জমাই। এ যেন বাড়ি যাওয়ার এক সুবর্ণ-সুযোগ আবার বেঁচে থাকার বদ্ধ কঠিন লড়াই। কারণ অন্যান্য দেশের মধ্যে দিনে হাজার খানেক লোক চিরতরে হেরে গিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। বাড়িতে গিয়ে দেখি গ্রামের পরিবেশে ভাইরাসের প্রকোপ নেই বললেই চলে তবে মানুষজন এই বিষয়ে অনেক বেশি আতঙ্কিত। গ্রামের লোকজন বাইরে যারা থাকতো অনেকেই প্রায় বাড়ি ফিরে এসেছে। দিন যতই এগিয়ে যাচ্ছে পরিস্থিতি ততই কঠিন হচ্ছে। একদিন সময় করে গ্রামের যুবকদেরকে নিয়ে আলোচনা শুরু করি করোনা প্রতিরোধ নিয়ে এবং রাতে গ্রাম মড়ল (প্রধান), গ্রাম উন্নয়ন কমিটি ও গ্রামের সকলকে নিয়ে আলোচনা করি। যেই কথা সেই কাজ। পহেলা বৈশাখের আগের দিন ১৩/০৪/২০২০ তারিখে গোপাল বাড়ী চেংগ্নী গ্রামে বহিরাগত প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করি। বহিরাগত কেউ যেন গ্রামে প্রবেশ করতে না পারে তার জন্য গেইট তৈরি এবং গেইটে প্রতিনিয়ত দুই জন ভলেন্টিয়ার হিসেবে কাজ করে। গ্রামের যুবকেরা সেচ্ছাসেবক (ভলেন্টিয়ার) হিসেবে কাজ করে এবং ভলেন্টিয়ার কমিটিও গঠন করা হয়।
নভেল করোনা ভাইরাস সম্পর্কে সচেতন ও ভাইরাস প্রতিরোধ সম্পর্কে গ্রামের প্রত্যেক পরিবারকে অবগত করা হয়। বয়স্ক লোক, অসুস্থ লোক ও ছোট বাচ্চাদের এ বিষয়ে আরো গুরুত্বর ভাবে সচেতন করা হয়। গ্রামের রাস্তা-ঘাট, প্রত্যেক পরিবারের উঠানে জীবাণুনাশক ঔষুধ (ব্লিচিং পাউডার ও পানি) কয়েকদিন পরপর ছিটানো হয়। আর জরুরী প্রয়োজনের তাগিদে যে সকল ব্যক্তি গ্রামের বাহিরে ও বাজারে যাচ্ছে তাদের মাস্ক ব্যবহারে বাধ্যতা এবং গ্রামে প্রবেশের আগে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার জন্য ব্যবস্থা করা হয়। অত্র এলাকার পাশাপাশি দু'টি বিজিবি ক্যাম্পের বিজিবিরাও তহলরত অবস্থায় গ্রামের সচেতন যুবকদের এমন উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই এবং বিজিবিরাও প্রশাসনিক সাহায্যের জন্য যেকোনো সময় তাদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য বলে।
আমার বাবা একজন কৃষক আর আমি তারই ছেলে। তিনি কৃষি কাজ করেন (সবজি চাষও করে থাকেন)। সেখান থেকেই ভাইরাস সমস্যা চলাকালীন ১৯/০৪/২০২০ তারিখ প্রায় ১০০ কেজি "করোলা সবজি" গ্রামবাসী সকলের মাঝে বিতরণ করি।
শ্রী শ্রী গর্গনাথ গোপাল ঠাকুর মন্দির (স্থাপিত: ১৮৪৫ সাল), গোপাল বাড়ী চেংগ্নী, লেংগুড়া, কলমাকান্দা, নেত্রকোণা। ঐতিহ্যবাহী একটি মন্দির। দোলযাত্রা উপলক্ষে প্রত্যেক বছর মন্দিরে ১৬ প্রহর কীর্তন ও ৫ (পাঁচ) দিন ব্যাপী মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এ যেন কলমাকান্দা এলাকার (দূর্গাপুর ও সুনামগঞ্জ অঞ্চলেরও) হাজং, গারো এবং বাঙালি সকল মানুষজনের মিলন মেলায় পরিণত হয়। ০৫/০৫/২০২০ তারিখ গ্রামের যুবকদের নিয়ে মন্দিরের কাঁটাতারের বেড়া ৩দিন যাবৎ পুনঃসংস্কার করি। ঐতিহ্যবাহী মন্দির হিসেবে সরকারী ভাবে গুরুত্ব/প্রাধান্য দেওয়া প্রয়োজন তার বিন্দুমাত্রও দেওয়া হয় না। মন্দির ঘেঁষেই উত্তর পাশে রয়েছে মন্দিরের ছোট টিলা/পাহাড়। যুবকদের-সহ আবার গ্রামের সবাইকে নিয়ে সুন্দর একটি উদ্যোগ গ্রহণ করি বৃক্ষ রোপনের। কেননা চারাগাছ লাগানো মন্দির ও গ্রাম উন্নয়ন করার ক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা পালন করবে। তাই ২০/০৫/২০২০ তারিখ মন্দিরের ছোট টিলা/পাহাড়ের ঝোপঝাড় কেটে পরিষ্কার করি এবং সম্পূর্ণ এরিয়া বাঁশের বেড়া-জাল দিয়ে ঘেরাও করি। যেন গরু ছাগল কোনো ভাবে চারাগাছ নষ্ট করতে না পারে। আর সেখানে ১১০০ (এগারো শত) চারাগাছ রোপন করি। পরিচর্যার কাজ প্রতিনিয়ত করা হচ্ছে আর প্রতিটি চারাগাছ পরিপক্ব ভাবে বেড়ে উঠছে।
মেঘালয় পাহাড় ঘেঁষে আমাদের ঠিকানা। তবে বর্ষাকালে কি যে যন্ত্রণা তা আমরাই জানি। মেঘালয়ের পাদদেশেই বাংলার বহু নদ-নদীর উৎপত্তি স্থান। বর্ষাকালে ধানক্ষেত, পুকুর, ঘরবাড়ির ক্ষতিগ্রস্ত ও চলাচলের অত্যন্ত বেহালদশা পোহাতে হয়। একদিন হঠাৎ কয়েকজন রাস্তায় ঘুরতে গিয়ে দেখি আমাদের গ্রাম থেকে অন্যস্থানে যাওয়ার অন্যতম মাধ্যম যে ব্রীজ আছে তা মাঝখানে ছিদ্র হয়ে ভেঙ্গে বড় আকার ধারণ করছে। অনেকের কাছ থেকে জানতে পেলাম স্থানীয় প্রতিনিধি (সরকারী লোক) এর সুব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এ বছরের মেলার জন্য মোটরসাইকেল, অটোরিকশা ও মালবহনকারী গাড়ির অত্যাধিক চলাচলের জন্য ব্রীজটির এমন দূর্দশা। গ্রামের রাস্তার ধারেই পাঁচ পাঁচটি দোকান রয়েছে। ঐ দোকানগুলোতে গিয়ে ২/৩ দিন সকলকে জানিয়ে দিলাম কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
১। ব্রীজটি পুনঃসংস্কার করা আমাদের কেন প্রয়োজন,
২। ব্রীজ পুনঃসংস্কার না করলে কি সমস্যা দেখা দিবে,
৩। ব্রীজ কেন পুনঃসংস্কার করবো ইত্যাদি।
কেননা ব্রীজ দিয়ে আমরাই চলাচল করি, ব্রীজটি যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম, পুনঃসংস্কার না করলে দুর্ভোগে আমাদেরই ভোগতে হবে (স্থানীয় প্রতিনিধিদের আশায় দিন গুনলে হবে না আমরা যদি সচেতন ও এক হয় তাহলে অনেক কিছুই করতে পারি)।
সবাই যার যেটুকু সামর্থ্য বা যা খুশি তা দান করলে বা সহযোগিতা করলে ব্রীজ পুনঃসংস্কার করা সম্ভব। কিছু টাকা সংগ্রহ করি। আর আমরা নিজেরাই লেংগুড়া নদী থেকে বালু পাথর নিয়ে আসি। সিমেন্ট ও রড কিনে আনি। সর্বশেষ ২৯/০৬/২০২০ তারিখ যুবকেরা সবাই মিলে ব্রীজটি পুনঃসংস্কার করি। যা,
"দ্যা ডেইলি স্টার" নিউজ পেপার ও অনলাইন নিউজ পেপারে ০২/০৭/২০২০ বিষয়টি প্রকাশিত করে ।
মহামারীর এমন পরিস্থিতিতে আজ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ঢলে পড়েছে। তবে অধিক ভাবে গ্রামের শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ভাইরাসের জন্য যেমন তারা অতি বিরক্ত তেমনি স্কুল বন্ধ থাকায় গ্রামের ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনায় বিমুখ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্রামে ভাইরাসের প্রকোপ যখন তিন মাস অধিক চলার জন্য তারা ভাইরাস ব্যাপারে খুব একটা কান-মুখ নাড়াই (গুরুত্ব দেয়) না। তবে আমাদের গ্রামকে আমরা গ্রাম হিসেবে দেখি না বরং একটি পরিবার ভাবি ও সে-ই হিসেবে চলি। সকাল হলেই এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি যায়। এগুলো শহরে বাধা নিষেধ করা সম্ভব, গ্রামে নয়। এছাড়াও গরু ছাগল তো আছেই ঘরে রাখা সম্ভব নয় ইত্যাদি। আমি নিজেই গ্রামে তিন মাস পাড়ি জমাই কিন্তু করোনার বিদায় ঘন্টা বাজলো না। *নিজ গ্রামের ছোট ভাই বোন রয়েছে তাদের একটু পড়াশোনায় সাহায্য করতে এগিয়ে আসি। স্বাস্থ্য বিধি মেনে নিয়েই আমরা যুবকেরা ১ম শ্রেণি হতে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনায় সাহায্য করার চেষ্টা শুরু করি।
আমার এলাকায় করোনা ভাইরাসের প্রভাবে সাধারণ মানুষের জীবন-যাপন খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা বাড়িতে দিনমজুরি বা চাকুরী করতো তারাও আজ ঘরে আবদ্ধ আবার যারা ঢাকায় বা বাইরে চাকুরী করতো সেসব লোকজন গ্রামে এসে কর্মহীন বেতন-ভাতাও পাচ্ছে না। এমতাবস্থায় সকলে দিশেহারা ও কুল-কিনারাহীণ হয়ে পড়েছে। ভাইরাস সমস্যা চলাকালীন ১/২ বার শুধুমাত্র ত্রাণ সহযোগিতা (প্রত্যেক পরিবারকে দেওয়া হয় নি) পায় কিন্তু এতেও সমস্যা সমাধান হচ্ছে না। আর পাহাড়ি ঢলের কারণেও ঘরবাড়ি, ধানক্ষেত, পুকুরের ক্ষয়ক্ষতি ও চলাচলের সমস্যা ক্রমাগত দেখা দিচ্ছে।
কিছুদিন আগে মানুষজন করোনার ভয়ে বাঁচার জন্য আতঙ্কিত ছিল। কিন্তু আজ তারাই পেটের ক্ষুধা মিটাতে অারো বেশি আতঙ্কিত ও চিন্তিত। অর্থাৎ মরার থেকে বাঁচার ভয় বেশি। না আছে তাদের চাকুরী, না পারছে গ্রামে গিয়ে কিছু করতে রোজগারি। প্রিয়জনের মুখের দিকে চেয়ে শুধু মনের মাঝে জাগ্রত স্বপ্নজাল বুনে। কল্পনার জগতে ভাসে।
*বিশ সালে যেন বিষেই ভরপুর। মায়াবী সকাল দুপুর কেটে গিয়ে গেয়ে ওঠে করোনার কঠিন সুর। সে যেন কাপিয়ে ও কাঁদিয়ে তুলেছে বিশ্ববাসীর প্রতিটি হৃদয়। হায়!
নাই উপায়, নাই কি বাঁচিবার কোথাও ঠাঁই?
সমস্যা যখন সৃষ্টি হয়েছে অর্থাৎ সমস্যার সমাধান নিশ্চয়ই রয়েছে। কিন্তু সমস্যা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সকলকে সচেতন - সতর্কতা অবলম্বন করে চলতে হবে। স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলতে হবে। নিজেকে নিরাপদ রাখতে হবে, নিজের পরিবারকেও নিরাপদ রাখতে হবে। আমাদের ঘরে থেকে, সমাজিক - দূরত্ব বজায় রেখে এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার নীতি মেনে চলে এই ভাইরাস সংক্রমণ থেকে বাঁচতে হবে৷ এই ভাইরাস কিভাবে ছড়ায় সেটাও আমাদের জানতে হবে৷ পরিবেশ নিয়েও হতে হবে সচেতন৷ নিজে নিরাপদ থাকুন, অন্যকেও নিরাপদ রাখুন।
আদিবাসী জনগনের কাছে এই কঠিনতম সময় পাড়ি দেওয়া অতি দূর্বিষহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনিতেই আদিবাসীরা প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করে। ত্রাণ সহযোগিতা পাচ্ছে কিনা, কিভাবে জীবন-যাপন করছে কেউ কারো খোঁজ নিতে পারছে না। কারণ এর ভুক্তভোগী আমরা সবাই। কিন্তু আমরা যখন সচেতন আদিবাসী নেতৃত্বধারী, ব্যক্তি-বর্গ, ছাত্র-সমাজ রয়েছি তাই আদিবাসী মানুষজনের কাছে আমাদেরকেই এগিয়ে যেতে হবে। এই মহামারীর সময় তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। আদিবাসী মানুষজনের পাশে অনেকেই (আদিবাসী নেতা, ছাত্রসমাজ) পাশে দাঁড়াচ্ছে তারপরও আমরা যতই সকলে মিলে পাশে দাঁড়াব ততই সমস্যা দূরীভূত হবে। আর আদিবাসীদের প্রত্যেকটি সমস্যা চিহ্নিত করতে হবে। সমস্যা না জানলে সমাধান আসবে না। আর সমস্যা চিহ্নিত করলে সমাধানের সর্বশেষ চেষ্টা করতেই হবে তাহলে সফলতা সম্ভব।
পরিশেষে একটি কথা বলি, আদিবাসী মোরা সকলে মিলি, প্রতিটি সমস্যার প্রতিরোধ গড়ে তুলি।
নাঈম হাজং(হাজং)
শিক্ষার্থী,
ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ
ঢাকা কলেজ, ঢাকা।
No comments