ভাষার মাসে ভাষা নিয়ে কিছু কথা

Waree N Marak-ওয়ারি এন মারাক

Waree N Marak


ভাষার মাসে ভাষা নিয়ে কিছু কথা

ভাষা শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে আমরা যাই করিনা সবই লোক দেখানো আমার মনে হয়। নিজ ভাষাকে অবহেলা করে অন্য ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন লোক দেখানো নেকামি ছাড়া কিছু হতে পারে না। যে নিজ ভাষাকে সন্মান দিতে ব্যর্থ সে আরেক ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা কিভাবে দেখাবে বা সন্মান করতে জানবে?

আসছে ২১ ফেব্রুয়ারি, আমাদের গারো ছেলেমেয়েরা রাত জেগে কাটিয়ে দিবে শহীদের শ্রদ্ধাঞ্জলির নামে। ভাষা শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন নিতান্তই একটা ভালো কিছু। আমার প্রশ্ন জাগে আমাদের গারো ছেলেমেয়েরা কি নিজ ভাষার প্রতি সত্যি সন্মান রাখে তাদের হৃদয়ের অন্তস্থলে??
চলুন একটু দেখে নেওয়া যাক গারো ছেলেমেয়েদের নিজ ভাষার প্রতি শ্রদ্ধার নমুনা ;

১। গারো ছেলেমেয়েদের ভাষা গত প্রধান সমস্যা হচ্ছে তারা নিজেদের মধ্যে কথোপকথনের সময় নিজের ভাষায় কথা বলে না। একটা গারো ছেলে অথবা মেয়ে আরেকটা গারো ছেলে অথবা মেয়ে কে জিজ্ঞেস করে অন্য ভাষায়। তাদের আড্ডায় অন্য ভাষাভাষীর কেউ না থাকলেও তারা বাংলায় কথোপকথন করবেই।
নিজেদের মধ্যে ভাষা চর্চা কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ বহন করে সেটা নিশ্চয়ই বলতে হবেনা।

২। আমাদের ছেলেমেয়েরা ফেইসবুকে লিখা লিখি অন্য ভাষায় করে থাকে। না লিখার কিছু কারনের মধ্যে একটি কারণ হচ্ছে নিজ ভাষায় লিখলে পাঠক থাকে না। শুধু মাত্র পাঠকের আশায় অথবা লাইক কমেন্টের আশায় গারো ছেলেমেয়েরা নিজ ভাষায় কিছু লিখে স্ট্যাটাস দিতে উদাসীন।

৩। ফেইসবুকে কনভারসেশনের সময় নিজ ভাষায় না করা এবং অন্য ভাষায় স্বাচ্ছন্দ বোধ করা।

৪। গারো ভাষায় গারো ছেলেমেয়ে কাউকে জিজ্ঞেস করলে অন্য ভাষায় উত্তর দেওয়া।

৫। গারো ভাষা থেকে অন্য ভাষায় কথা বলা স্মার্টনেস মনে করা। এবং পারিনা বলে অযুহাত দেখানো।

আসুন দেখে নেওয়া যাক আমাদের অভিভাবক, নেতা নেতৃ, শিল্পী সাহিত্যিক, লেখক গবেষক ও সংস্কৃতি কর্মীদের নিজ ভাষার প্রতি সন্মানের নমুনা ;

১। একটা গারো ছেলে অথবা মেয়ের নিজ ভাষায় কথা বলতে না পারার জন্য তার অভিভাবক সরাসরি দায়ী। গারো সমাজে তথাকথিত প্রতিষ্ঠিত শিক্ষিত অনেক অভিভাবক রয়েছে নিজের বাসায় সন্তানদের সাথে অন্য ভাষায় কথা বলে এবং স্মার্ট মনে করে। এভাবে নিজের পরিবার থেকেই অবহেলিত হয় গারো ভাষা।

২। গারোদের বড় বড় উৎসব অনুষ্ঠানে গারো নেতা নেতৃ, শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি, লেখক গবেষক এবং সংস্কৃতি কর্মীরা কখনোই নিজ ভাষায় বক্তব্য দেয়না। গারোদের কে কিছু উদ্দেশ্য করে বললেও অন্য ভাষা তাদের প্রয়োজন হয়ে পরে। অবশ্য লজ্জার বিষয় হলেও সত্য যে আমাদের সন্মানিত নেতা নেতৃ, কবি, শিল্পী সাহিত্যিক, লেখক গবেষকরা নিজেরাই ঠিকমত কথা বলতে পারে কিনা সন্দেহ।

৩।  সাহিত্য চর্চা না করা।
চরম পরিতাপের বিষয় হচ্ছে সাহিত্য চর্চার অভাব বা না করা।
আমাদের কবি, শিল্পী সাহিত্যিক, লেখক ও গবেষকরা সাহিত্য চর্চাই করে অন্য ভাষায়, সুতরাং যে জাতির মাথা মগজে পচন সেখান থেকে এরকম চিন্তা ধারার মানুষ আশা করাটাও একটা বোকামি।
সম্প্রতি কালে গারোদের দুটি প্রকাশনালয় রয়েছে নিঃসন্দেহে ভালো দিক। আমার বোধগম্য নয় দুটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আদৌ গারো সাহিত্য নিয়ে ভাবেন কিনা নাকি উনারা মনেই করেন যে গারোদের নিয়ে কোন গল্প, গান, কবিতা, উপন্যাস,  ছড়া, প্রবন্ধ এবং গবেষণা মূলক কোন বই বাংলায় অথবা ইংলিশ ভাষায় লিখলে সেটি গারো সাহিত্য হয়ে যাবে!!!
যদি তাই হয় সাহিত্যের সজ্ঞাটাই পরিবর্তন করতে হবে মনে করি।
গারোদের নিয়ে অন্য ভাষায় কোন বই লিখলে তার মাধ্যমে বড়জোর গারোদের কিছু পরিচিতি করানো যেতে পারে, সেটা অন্তত গারো লিটারেচার হবেনা।

৪। পাঠকের অভাব
আমাদের গারো কবি, শিল্পী সাহিত্যিক, লেখক গবেষকরা মূলত পাঠক নির্ভর। পাঠকের রুচি, চাহিদার উপর নির্ভর করে বই লিখার চেষ্টা করেন। না হলে বই গুলো বাংলায় না হয়ে গারো ভাষায় হওয়ার কথা ছিলো।

৫। আমাদের গারো গ্রেজুয়েশন ধারী সমাজের সমাজ পতিদের সন্তানদের নাম হয় বাংলা, ইংলিশ, হিন্দি অথবা গ্রিক মিথলজির কোন নাম। সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় সমাজ পতিদের মনেই থাকে না নিজ ভাষায় হাজারো নাম আছে যে নাম গুলো নিজ সন্তানের নাম রাখা যায়। অবশ্য গারো ভাষায় নাম রাখলে অন্যরা বুঝে ফেলবে গারোর বাচ্চা। তাছাড়া গারো নাম তো স্মার্ট শোনা যায়না।
পারলে চোখ নাক ছোট গারোর বাচ্চার সার্জারি করে চোখ নাক বড় করে ফেলতেন মনে হয়।

৫। নিজ ভাষায় গান না করা
বিনোদনের একটি ভালো মাধ্যম হচ্ছে সঙ্গীত। আমাদের দেশে অনেক গুলো গারো ব্যান্ড এবং সলো আর্টিষ্ট রয়েছে যারা বিভিন্ন সময় গারো গান নিয়ে কাজ করে। এদের মধ্যেও বাংলা ইংলিশ গানের প্রতি বেশি আগ্রহ দেখা যায়। গারো ছেলেমেয়েদের গারো গানের প্রতি ভাললাগার জায়গাটি করে দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের মিউজিক কমিউনিটির রয়েছে।  রুচিসম্মত মিউজিক এবং মিউজিক ভিডিও তৈরী করতে হবে।

৬। ভাষা নিয়ে কোন সভা সেমিনার না থাকা
বছরে ডজনে ডজন সভা সেমিনার হলেও নিজ ভাষা নিয়ে কোন সভা সেমিনারের হয়না। আমাদের অস্তিত্বের জন্য যতই সভা সেমিনার করিনা কেনো একটা জাতির অস্তিত্বের জন্য ভাষা কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ সেটাও ভুলে যাই। একটা জাতির ভাষা নেই মানে তার অস্তিত্বই নেই।
সমাজের বড় বড় নেতা নেতৃদের এই নিয়ে ভাবতে হবে, ইনিশিয়েটিভ নিতে হবে এখনি কিভাবে নিজ ভাষাকে রক্ষা করতে হবে।

৭। ভাষা শিক্ষা
আমাদের নেতা নেতৃ, কবি সাহিত্যিক, লেখক গবেষক ও সংস্কৃতি কর্মীরা অনেকেই নিজ ভাষায় কথা বলতে পারেনা।
যাই পারুক বাংলা মিশিয়ে কথা বলেন। নিজেই যদি নিজের ভাষা ঠিকঠাক বলতে না পারে তাহলে সন্তানদের কিভাবে শেখাবেন! প্রশ্ন থেকে যায়। অনেকের মধ্যে নিজ ভাষা ভালো মত শিখার বা জানার মন মানষিকতাও নেই। অনেকেই আবার গারো রাইটিং সিস্টেম না জানায় বাংলা বরণমালা দিয়ে লিখার চেষ্টা করে কিন্তু বাংলায় অনেক সময় সম্পূর্ণ ভাব প্রকাশ করা সম্ভব হয়ে উঠে না কারণ "আ" এর পর আবার "আ" কার চলে আসে।

( বিঃদ্রঃ সংসারেক বই থেকে কিছু অংশ)

No comments

Theme images by saw. Powered by Blogger.