ফা. জিনেন্দ্র সাংমা

Swatirtho F Chiran.

 কবি এবং তরুণ লেখক



ফা. জিনেন্দ্র সাংমা










ফা.জিনেন্দ্র সাংমা



আমাদের দেশে মান্দি সমাজে অধিকাংশ লোক এমন রয়েছে যাদেরকে অনেকেই আমরা চিনিনা কিংবা জানিনা কিন্তু দেশ জাতি ও সমাজ গঠনে যাদের অবদান অনস্বীকার্য। যাদের অবদান না থাকলে অনেক কিছু সম্ভব হতো না বা হওয়া সম্ভব ছিল না। অধিকাংশ লোকেরাই তাদের কাজের জন্য তেমন সম্মান কিংবা পরিচিতি লাভ করতে পারে নি, পরিচিতি লাভ করতে দেওয়া হয়নি। বর্তমান ময়মনসিংহ বিভাগের শেরপুর জেলাতেও তেমনি কিছু উল্লেখযোগ্য কিংবদন্তী আছেন , যাদের মধ্যে টিপু অন্যতম । যার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস পাওয়া যায় বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে । শেরপুরে গারোরা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন করেছিলেন টিপু গারোর নেতৃত্বে বলে উল্লেখ আছে সেখানে । আরো রয়েছে ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক জিনেন্দ্র সাংমা যার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস এবং অবদানগুলু আজ তুলে ধরছি ।
জিনেন্দ্র সাংমা আমাদের মান্দিসমাজে শুধু একটি নামই না আমাদের সবার আদর্শ । তিনি একি সাথে দেশ, সমাজ এবং নিজের জাতির জন্য অনেক অবদান রেখেছেন । নিজের জাতির মানুষ উনার ইতিহাসকে অবহেলা করলেও এদেশের ঐতিহাসিকদের রচিত শেরপুরের মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাসে উনার ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে ।

 তিনি শুধুমাত্র বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদান রেখেছেন এমন নয় মানবতা রক্ষার্থে ১৯৩৯ হতে ১৯৪৫ পর্যন্ত যে ২য় বিশ্বযুদ্ধ হয়েছে সেখানেও তার অবদান রয়েছে। ব্রিটিশ শাসক এভূখন্ডে প্রায় ২০০ বছর শাসন চালায় যাদের লূটপাট অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিল এ ভূখন্ডের মানুষ । এ সময়ে অনেক দেশপ্রেমিক ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন করেন । ১৯৩৯ এর দিকে বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ শুরু হয় যেখানে ছোট বড় অনেক দেশ জড়িয়ে পরে যা পরিনত হয় ২য় বিশ্বযুদ্ধে। বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলুর শক্তি প্রদর্শনের ক্ষেত্র হয়ে যায় যেখানে রাশিয়া থেকে শুরু করে ইংল্যান্ড , জার্মান, ফ্রান্সসহ আরো অনেক দেশ অংশ নিয়েছিল  ।মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে তখন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন জোরদার হতে থাকে । ব্রিটিশরা অনেক ঝামেলায় পড়ে যায় , তাদের পক্ষে একসাথে ২য় বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধ চালানো ও ভারতে আন্দোলনকারীদের দমানো অনেক কঠিন হয়ে উঠে । সে সময় ভারতের সাথে সন্ধি করে যদি তারা ২য় বিশ্ব যুদ্ধে ব্রিটিশদেরকে সহায়তা করে তাহলে তাদের দাবি মেনে নেওয়ার কথা ভাববে । তাদের আস্বাসে বিশ্বাস করে শত শত ভারতীয় সেনা ২য় বিশ্বযুদ্ধ্বে অংশগ্রহন করে তাদের মধ্যে শেরপুরের মান্দিপাড়ার জিনেন্দ্র সাংমাও ছিলেন একজন । তিনি ২য় বিশ্ব যুদ্ধে ব্রিটিশ সৈনিকের ওয়ারেন্ট অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন । তাদের সেনা জার্মানির হিটলারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে একে একে বিজয় লাভ করে । ১৯৩৯-১৯৪৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ বহুবছর যুদ্ধের পর ২য় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটলে তিনি বাকি ভারতীয় সেনাদের সাথে দেশে ফিরে আসেন এবং ১৯৪৭ সালে এই ভূখন্ড ব্রিটিশ শাসন হতে চিরতরে অবসান লাভ করে ।

এসময়ে দেশ ভাগ হলে পাকিস্তান আমলে তিনি পুলিশ অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন ।দায়িত্বরত অবস্থায় তিনি অনেক কিছু লক্ষ্য করেন পশ্চিম পাকিস্তানিদের সংখ্যালঘু পূর্ব পাকিস্তানের উপর অমানবিকতা নির্যাতন শোষন এই ব্যাপারগুলু তাকে ব্যাতিত করতো । ব্রিটিশদের প্রায় ২০০ বছর শাসনে যে অত্যাচার ছিল সেইরূপ অত্যাচার সে পাকিস্তানের শাসন আমলেও লক্ষ্য করে । ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন যখন শুরু হয় তিনি পুলিশের চাকরি ছেরে দেন এবং ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেন । পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে হাজারো মানুষের মত তিনিও সারা দেন । স্বাধীনতা ঘোষনা দেওয়া হয়েছিল কিন্তু এদেশের অধিকাংশ মানুষ ছিল কৃষক শ্রমিক আর মেহনতি মানুষ যারা যুদ্ধের কোন কলাকৌশল জানতো না । তাদের অধিকাংশ লোকেরা ভারতে গিয়ে যুদ্ধের কৌশল শিখে  যুদ্ধ শুরু করে । সারা দেশে সাধারন মানুষ মুক্তিযোদ্ধে অংশগ্রহন করেছেন সবাই জানেন, অনেক কম লোকেরাই এটা জানেন যে মুক্তিযোদ্ধের সময় বাড়ি বাড়ি গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা তৈরী করতে হয়েছে তাদেরকে অস্ত্র সংগ্রহ এবং প্রশিক্ষন দিতে হয়েছে । ঠিক তেমনি ঝিনাইগাতী, নালিতাবাড়ি , শ্রীবর্দী , শেরপুরে ১৩ জন লোক বাড়ি বাড়ি গিয়ে লোক যোগার করে তাদের অস্ত্র যোগার করে দিয়েছেন প্রশিক্ষন দিয়েছেন সেই ১৩ জন লোকের মধ্যে জিনেন্দ্র সাংমার অবস্থান ছিল অষ্টম । তিনি শুধু মুক্তিযোদ্ধা সংগঠকই নন তিনি প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধ করেছেন পরবর্তীতে পরিবারের লোকেদের কথা চিন্তা করে তিনি তাদের ভারতে দিয়ে আসেন এবং নিজের বড় দুই ছেলেকে প্রশিক্ষন দিয়ে মুক্তিযোদ্ধে পাঠিয়েছেন ।


মুক্তিযুদ্ধের সময় নানা ভাবে পরোক্ষ ও প্রতক্ষভাবে সহায়তা করেন  এবং পরিকল্পনা করে দিতেন  কখন কোথায় কিভাবে শত্রুদের উপর আক্রমন করতে হবে । সময় অতিবাহিত হতে থাকল দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করলো ।  স্বাধীন দেশে এসে দেখলেন যুদ্ধের ভয়াবহতায় সব কিছু তছনছ হয়ে গেছে , শরনার্থীরা নিজের জন্মভূমিতে ফিরা শুরু করলো কিছু কিছু শরনার্থীদের তিনি নিজ বাড়িতে আশ্রয়ও দিয়েছেন । তিনি দেখলেন স্বাধীন দেশে সবাই ফিরেছে সবকিছু নতুন করে গুছিয়ে নিয়েছে । নতুন প্রজন্মের এগিয়ে যাওয়ার জন্য জরুরী ছিল পড়াশোনা কিন্তু পড়াশোনার জন্য কোথাও কোন বিদ্যালয় ছিল না , তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করবেন এই পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে কমিটি গঠন করে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলেন যার বর্তমান নাম ঝিনাইগাতী মডেল পাইলট স্কুল এবং মেয়েদের জন্য  বালিকা  বিদ্যালয় । তিনি দেশ জাতি এবং সমাজের জন্য তো অনেক করেছেন কিন্তু যুদ্ধের ভয়াবহতার কারনে ব্যক্তিগত জীবনে আর্থিকভাবে পিছিয়ে যান , এমনও দিন এসেছে তিনি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন ধান বিক্রি করে পরিশোধ করেছেন তবুও তিনি পিছ পা হননি সাহসের সাথে এগিয়ে গেছেন এবং রাজনীতিতে এসে রাস্তাঘাট ব্রীজ নির্মান করেছেন ।


 মান্দি সমাজেও রেখেছেন অনন্য অবদান শেরপুর জামালপুরের মান্দিরা অগ্রসর হয়েছেন উনার দেখানো পথ অনুসরন করেই । নিস্বার্থভাবে কাজ করে গিয়েছেন পরিবর্তে পরিবারকে ভোগ করতে হয়েছে অমানবিক নির্যাতন এবং শোষণ। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যখন স্বপরিবারে হত্যা করা হয় এবং অন্য সরকার ক্ষমতায় আসেন তখন স্বদেশকে ভালবাসার প্রতিদান উনাকে দিতে হয়েছে । উনার পরিবারকে সহ্য করতে হয়েছে অমানবিক নির্যাতন লাঞ্চনা ঠিক তেমনি দেশদ্রহীর মত ১২ টি মিথ্যা মামলা দিয়ে দমিয়ে দেয়া হয়েছে উনার অবদানের ইতিহাস । সেনাবাহিনীর দ্বারা সহ্য করেছেন শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন তার পরও উনার মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা কমেনি  মৃত্যুর আগে পর্যন্ত দেশ , সমাজ এবং মানুষের কল্যানে নিস্বার্থ কাজ করে গেছেন । জিনেন্দ্র সাংমার আদর্শ উনার দেখানো পথ আজও অনেকের মাঝে ধাবিত হয় এবং ভবিষ্যতেও হবে । আমরা উনাকে গভীর শ্রদ্ধাভরে সম্মান জানাই ।

No comments

Theme images by saw. Powered by Blogger.