জীবন টক দইয়ের মতো নাকি খাজার মতো মিষ্টি?
জীবন টক দইয়ের মতো নাকি খাজার মতো মিষ্টি?
কবি পরাগ রিছিল
তখন সবেমাত্র হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছি। আমাদের বিড়ই ডাকুনী উচ্চ বিদ্যালয়ের সুবর্ণ জয়ন্তী পালিত হবে। চারদিকে উৎসবমুখর ভাব। সাজসাজ রব। ধৈর্যহীন ভাবে চারটি ক্লাস কোনোমতো শেষ করি। তারপর ক্লাস ছুটি। স্কুলের কোনো অংশে চলে গান প্র্যাকটিস, কোথাও নাচ, কোথাও নাটকের রির্হাসেল। স্কুল পেরিয়ে যাওয়া নাচে-গানে এক্সপার্ট রুবি' দি এসেছেন নাচ-গানের ট্রেনিং দিতে। আর আমাদের যাদের তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজ নেই, কোদাল দিয়ে কুপিয়ে ফুটবল মাঠের দাগ নির্ধারণ, ভলিবল কোর্ট তৈরি, কুপিয়ে, আবার তার উপর অাঠা ছিটিয়ে। কখনো ছাত্র-শিক্ষক মিলে ভলিবল খেলা। উৎসব হবে টানা দু' তিন দিন ধরে।
সে সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের " ডাকঘর" নাটকটিও মঞ্চস্থ হয়েছিল। অমল চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ক্লাস নাইনের সিনিয়র ছাত্র- রতন। এর আগে কিছু ডায়লগ প্রতিদিন শুনতে শুনতে প্রায় মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। যেমন- দই ওয়ালার, "দই নেবে, দই?" অমল চরিত্রে হালকা-পাতলা গড়নের রতন চরিত্রের গভীরে মিলেমিশে প্রায় একাকার হয়ে গিয়েছিলেন বাংলার পরিমল দত্ত স্যারের নির্দেশনায়। মূল নাটকের দিন কারো কারো চেহারা আর চিনতেই পারিনি! মাথায় ডাস্টারের গুড়ো মেখে কারো চুল পাকা!
তো, রবি ঠাকুরের সৃষ্ট জানলার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা মনখারাপ অমলের ছিল যেমন একজন দইওয়ালা। আমার ব্যক্তিজীবনের বেড়ে ওঠা সময় থেকে আজঅব্দি পেয়েছি এক দইওয়ালাকে। আজ তাঁকে নিয়েই মূল লেখাটা।
প্রাইমারী স্কুলে পড়া থেকে শুরু করে উচ্চ বিদ্যালয়- কলেজ, তারপর পড়াশোনা শেষ করার পর এখনো দেখি একজনকে, যিনি বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে হেঁটে দই বিক্রি করতে নিয়ে যান। পাকা চুল, একই রকম চেহারার গড়ন। আশ্চর্য, তাঁর বয়সের যেন কোনো বাড়াকমা নেই!
ছোটবেলা তাঁর কাছ থেকে কিনে খেতাম সু-স্বাদু খাজা আর তকতি। এবার এক দুপুরে জানতে চাই, তাঁর নিজের জীবনের কথা।
অনন্ত চন্দ্র ঘোষ, বয়স বর্তমানে ৬৯ বছর। বসবাস করেন হালুয়াঘাটের সাহা পাড়ায়, ভাড়া বাড়িতে। চিনি, ময়দা, তেল, দুধ দিয়ে বাড়িতে নিজের হাতে বানান সন্দেশ, তকতি, খাজা, দই, গোল্লা। তারপর সেই পসরা কাঁধে নিয়ে হেঁটে বেড়ান গ্রামের পর গ্রাম। নিয়মিত প্রতিদিন হাঁটেন ১০-১২ মাইল।
আদিবাস ছিল টাঙ্গাইলে। টাঙ্গাইলের কোথায়? মধুপুরে। মধুপুর শুনে চমকে উঠি, মধুপুরের কোথায়? মাগন্তীনগর। মাগন্তীনগর তো চলেশ রিছিলের বাড়ি! হ্যাঁ, আমাদের বাড়িও ছিল মাগন্তীনগরের বটতলায়। বড়, সম্ভ্রান্ত পরিবার ছিল তাঁদের। পূর্বপুরুষদের মধ্যে শ্যামাচরণ মন্ডল আর শ্রীবাস মন্ডলের মধ্যে প্রথম ক্যাচাল বাঁধে। বাপ- চাচারা ছিল ১৫ জন। পরে তা দাঁড়ায় বৃহৎ আকারে। সংখ্যায় বৃহত্তর জনগোষ্ঠীদের সাথে মামলা-মোকদ্দমায় গড়ায়। মোট ৫৩৬ একর জমি নিয়ে বেঁধেছিল মামলা। তাঁর পূর্বপুরুষ অংশীদার মামলায় ডিক্রী পেলেও জমিজমার দখল আর বুঝে পায়নি। অনন্ত চন্দ্র ঘোষ চলে এসেছিলেন এই হালুয়াঘাটে ১৯৭৩ সালে। মিষ্টি তাঁদের কোনো পারিবারিক ব্যবসা ছিল না। এখানে আসার পর কষ্টে পড়ে কাজ নেন হোটেলে। হোটেলে কাজ করতে করতে এসব বানানো শিখেন। মিষ্টিজাতীয় সব ধরনের কাজ জানেন অনন্ত। স্ত্রী করেন বাবুর্চির কাজ। এক মেয়ে, এক ছেলের মধ্যে মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। পরিবারে সদস্য সংখ্যা এখন মাত্র ৩ জন।
বছরে ১ মাস ( কার্তিক) কেবল নিরামিষ ভোজন করেন অনন্ত চন্দ্র ঘোষ। বিড়ি, পান, সিগারেট কোনকিছু খান না। প্রতিদিন গড়ে ১০-১২ মাইল মতো কেবল অন্তহীন হাঁটতে থাকা?
প্রতিদিন বিক্রী হয় ৮০০/ ৯০০ টাকা। তাতে কিছু লাভ থাকে। কোনোমতে পেটেভাতে চলে যায়। অনন্ত চন্দ্র ঘোষের বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ কাস্টমার কোমলমতি অবুঝ ছোট্ট ছেলেমেয়েরা। তারা পাঁচ টাকা দিয়ে কিনে নেয় একটি খাজা, তকতি বা গোল্লা। হেঁটে ফেরি করতে করতে উপজেলার অনেক গ্রামই অনন্তদার খুব পরিচিত। যেসব গ্রামে আগে যেতে হতো ধুলোমাটির রাস্তায়, সেসব কিছু গ্রামে এখন হয়ে গেছে পিচের রাস্তা।
বড্ড একাকী দুপুরে; দইওয়ালা অনন্তদা' কে গ্রামের ভেতর ঢুকে হেঁটে যেতে দেখেছি। আবার কোনো বিষণ্ন বিকেলে, কাঁধে করে তার খালি পায়লা নিয়ে ফিরে যেতে। তাঁর জীবনের গল্প শুনে এবার আপনারাই বলুন, দুঃখ জমে- দুধের সর জমে যেমন তৈরি হয় টক দই, জীবন এমন? নাকি শরীর ঠিক রেখে বোঝা কাঁধে অনন্তদা'র মতো কেবল অন্তহীন হাঁটতে থাকা?
কবি পরাগ রিছিল
তখন সবেমাত্র হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছি। আমাদের বিড়ই ডাকুনী উচ্চ বিদ্যালয়ের সুবর্ণ জয়ন্তী পালিত হবে। চারদিকে উৎসবমুখর ভাব। সাজসাজ রব। ধৈর্যহীন ভাবে চারটি ক্লাস কোনোমতো শেষ করি। তারপর ক্লাস ছুটি। স্কুলের কোনো অংশে চলে গান প্র্যাকটিস, কোথাও নাচ, কোথাও নাটকের রির্হাসেল। স্কুল পেরিয়ে যাওয়া নাচে-গানে এক্সপার্ট রুবি' দি এসেছেন নাচ-গানের ট্রেনিং দিতে। আর আমাদের যাদের তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজ নেই, কোদাল দিয়ে কুপিয়ে ফুটবল মাঠের দাগ নির্ধারণ, ভলিবল কোর্ট তৈরি, কুপিয়ে, আবার তার উপর অাঠা ছিটিয়ে। কখনো ছাত্র-শিক্ষক মিলে ভলিবল খেলা। উৎসব হবে টানা দু' তিন দিন ধরে।
ছবি:পরাগ দা দিয়েছে |
সে সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের " ডাকঘর" নাটকটিও মঞ্চস্থ হয়েছিল। অমল চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ক্লাস নাইনের সিনিয়র ছাত্র- রতন। এর আগে কিছু ডায়লগ প্রতিদিন শুনতে শুনতে প্রায় মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। যেমন- দই ওয়ালার, "দই নেবে, দই?" অমল চরিত্রে হালকা-পাতলা গড়নের রতন চরিত্রের গভীরে মিলেমিশে প্রায় একাকার হয়ে গিয়েছিলেন বাংলার পরিমল দত্ত স্যারের নির্দেশনায়। মূল নাটকের দিন কারো কারো চেহারা আর চিনতেই পারিনি! মাথায় ডাস্টারের গুড়ো মেখে কারো চুল পাকা!
তো, রবি ঠাকুরের সৃষ্ট জানলার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা মনখারাপ অমলের ছিল যেমন একজন দইওয়ালা। আমার ব্যক্তিজীবনের বেড়ে ওঠা সময় থেকে আজঅব্দি পেয়েছি এক দইওয়ালাকে। আজ তাঁকে নিয়েই মূল লেখাটা।
প্রাইমারী স্কুলে পড়া থেকে শুরু করে উচ্চ বিদ্যালয়- কলেজ, তারপর পড়াশোনা শেষ করার পর এখনো দেখি একজনকে, যিনি বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে হেঁটে দই বিক্রি করতে নিয়ে যান। পাকা চুল, একই রকম চেহারার গড়ন। আশ্চর্য, তাঁর বয়সের যেন কোনো বাড়াকমা নেই!
ছোটবেলা তাঁর কাছ থেকে কিনে খেতাম সু-স্বাদু খাজা আর তকতি। এবার এক দুপুরে জানতে চাই, তাঁর নিজের জীবনের কথা।
অনন্ত চন্দ্র ঘোষ, বয়স বর্তমানে ৬৯ বছর। বসবাস করেন হালুয়াঘাটের সাহা পাড়ায়, ভাড়া বাড়িতে। চিনি, ময়দা, তেল, দুধ দিয়ে বাড়িতে নিজের হাতে বানান সন্দেশ, তকতি, খাজা, দই, গোল্লা। তারপর সেই পসরা কাঁধে নিয়ে হেঁটে বেড়ান গ্রামের পর গ্রাম। নিয়মিত প্রতিদিন হাঁটেন ১০-১২ মাইল।
আদিবাস ছিল টাঙ্গাইলে। টাঙ্গাইলের কোথায়? মধুপুরে। মধুপুর শুনে চমকে উঠি, মধুপুরের কোথায়? মাগন্তীনগর। মাগন্তীনগর তো চলেশ রিছিলের বাড়ি! হ্যাঁ, আমাদের বাড়িও ছিল মাগন্তীনগরের বটতলায়। বড়, সম্ভ্রান্ত পরিবার ছিল তাঁদের। পূর্বপুরুষদের মধ্যে শ্যামাচরণ মন্ডল আর শ্রীবাস মন্ডলের মধ্যে প্রথম ক্যাচাল বাঁধে। বাপ- চাচারা ছিল ১৫ জন। পরে তা দাঁড়ায় বৃহৎ আকারে। সংখ্যায় বৃহত্তর জনগোষ্ঠীদের সাথে মামলা-মোকদ্দমায় গড়ায়। মোট ৫৩৬ একর জমি নিয়ে বেঁধেছিল মামলা। তাঁর পূর্বপুরুষ অংশীদার মামলায় ডিক্রী পেলেও জমিজমার দখল আর বুঝে পায়নি। অনন্ত চন্দ্র ঘোষ চলে এসেছিলেন এই হালুয়াঘাটে ১৯৭৩ সালে। মিষ্টি তাঁদের কোনো পারিবারিক ব্যবসা ছিল না। এখানে আসার পর কষ্টে পড়ে কাজ নেন হোটেলে। হোটেলে কাজ করতে করতে এসব বানানো শিখেন। মিষ্টিজাতীয় সব ধরনের কাজ জানেন অনন্ত। স্ত্রী করেন বাবুর্চির কাজ। এক মেয়ে, এক ছেলের মধ্যে মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। পরিবারে সদস্য সংখ্যা এখন মাত্র ৩ জন।
বছরে ১ মাস ( কার্তিক) কেবল নিরামিষ ভোজন করেন অনন্ত চন্দ্র ঘোষ। বিড়ি, পান, সিগারেট কোনকিছু খান না। প্রতিদিন গড়ে ১০-১২ মাইল মতো কেবল অন্তহীন হাঁটতে থাকা?
প্রতিদিন বিক্রী হয় ৮০০/ ৯০০ টাকা। তাতে কিছু লাভ থাকে। কোনোমতে পেটেভাতে চলে যায়। অনন্ত চন্দ্র ঘোষের বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ কাস্টমার কোমলমতি অবুঝ ছোট্ট ছেলেমেয়েরা। তারা পাঁচ টাকা দিয়ে কিনে নেয় একটি খাজা, তকতি বা গোল্লা। হেঁটে ফেরি করতে করতে উপজেলার অনেক গ্রামই অনন্তদার খুব পরিচিত। যেসব গ্রামে আগে যেতে হতো ধুলোমাটির রাস্তায়, সেসব কিছু গ্রামে এখন হয়ে গেছে পিচের রাস্তা।
বড্ড একাকী দুপুরে; দইওয়ালা অনন্তদা' কে গ্রামের ভেতর ঢুকে হেঁটে যেতে দেখেছি। আবার কোনো বিষণ্ন বিকেলে, কাঁধে করে তার খালি পায়লা নিয়ে ফিরে যেতে। তাঁর জীবনের গল্প শুনে এবার আপনারাই বলুন, দুঃখ জমে- দুধের সর জমে যেমন তৈরি হয় টক দই, জীবন এমন? নাকি শরীর ঠিক রেখে বোঝা কাঁধে অনন্তদা'র মতো কেবল অন্তহীন হাঁটতে থাকা?
পরাগ দার লেখা বরাবরই ভাল লাগে। ধন্যবাদ দাদা লেখাটার জন্য, ধন্যবাদ জাডিল।
ReplyDeleteপড়ার জন্য এবং সাথে থাকার জন্য, আপনাকেও ধন্যবাদ।
ReplyDelete