প্রতি, বন্ধু বর্ষা রায় চৌধুরী।
প্রতি, বন্ধু বর্ষা রায় চৌধুরী।
জাডিল মৃ(Jadil Mri)
১.
সমবেদনা বা সান্ত্বনা দেওয়ার মতো ভাষা আমার জানা নেই।ইচ্ছে করেই ফোন কিংবা এসএমএস করিনি।কারণ সাহস হচ্ছিল না। কী বলবো তা নিজেও বুঝতে পারছিলাম না।তবুও একটি কথা বলবো, সবসময় ভালো থেকো; হাসিখুশি থেকো।ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুক, এই প্রার্থনা।
#বিনাচিকিৎসায়আমারবন্ধুরবাবামারাগিয়েছেন।
এই লেখাটা ক'দিন আগে(মৃত্যুর পরের দিন ১৫ জুন) ফেইসবুকে লিখেছিলাম।মন মানছিলো না তাই একটু স্মৃতিচারণ করতে মনস্থির করলাম।
২.
ভেবেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ছোটছোট ঘটনা স্মরণে রাখার জন্য ক্যাম্পাস জীবন শেষ হলেই লেখা শুরু করবো।কিন্তুু একটি ঘটনার জন্য তা পরিবর্তনে সংকোচবোধ করলাম না।কারণ, যদি না করতাম তাহলে নিজেকে অপরাধী মনে হতো।তাই এই করোনাভাইরাস বা লকডাউনে কিছু স্মৃতিচারণ করছি যেহেতু হাতে প্রচুর সময় আছে।যদিও এখনি উপযুক্ত সময় ছিল না। তবুও পরিস্থিতির কারণে লিখতে বাধ্য হলাম।
৩.
আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন ছাড়া, ঘনিষ্ঠ বাঙালি বন্ধু বলতে কেউ ছিল না।বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর তবুও গুটিকয়েক যাদের কে পছন্দ হয়/হয়েছে বা যাদের সাথে কথা বলতে,আড্ডা দিতে কিংবা ব্যক্তিগতভাবে যাদের সাথে চলাফেরা করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি তাদের মধ্যে অন্যতম বর্ষা রায় চৌধুরী।তার সাথে এতটা ঘনিষ্ঠ বলা যাবে না তবে বন্ধু(মানুষ) হিসাবে পছন্দ করি সেটা বলতে পারি। পছন্দের তালিকায় আরো অনেকেই আছে। তবে সংখ্যায় খুবই কম।কারণ সবার সাথে কথাবার্তা বা চিন্তা-ভাবনার সাথে ঠিক যেতো(যাই) না।আমার পছন্দের ধরণ আলাদা বলেই হয়তো পছন্দের মানুষ কম।আমি সবসময় খেয়াল করতে পছন্দ করতাম তার বা তাদের চিন্তা শক্তি কতদূর মানে চিন্তাভাবনা কতটুকু উন্নত(আমি যে মতাদর্শ পছন্দ করি)।যদি মিলে যেতো তাহলেই পছন্দ হতো,কেন জানি ভেতর থেকে পছন্দের ফুল ফুটতো।
৪.
প্রথম কোথায় দেখা হয়েছিল তা মনে নেই।তবে বুনিং(শীর্ষ রাকসাম) একদিন পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল,তা বেশ মনে আছে। তখন সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি।ক্যাম্পাসের পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে পারিনি।সেইজন্য কোন কিছুই ঠিক মতো চিনে উঠতে পারছিলাম না।যখন আস্তে আস্তে সবকিছু স্বাভাবিক হতে লাগলো এবং চিন্তা-ভাবনা গুলো সবার সাথে শেয়ার করতে থাকলাম বা শুনতে থাকলাম।এবং বোঝাপড়া তৈরি হতে থাকলো,সবাই সবাইকে জানতে পারলো /জানতে থাকলাম তখন বুঝতে পারলাম বর্ষা রায় চৌধুরী সবার মতো নয়।আমার ধারণা ঠিক ছিল, সত্যিই সবার মতো ছিল না।অন্যান্য মেয়ের থেকে চিন্তা-ভাবনা দিক দিয়ে অনেক প্রগতিশীল ও নিজেদের কে মানুষ হিসাবে ভাবতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো।আমি তার কাছে কোনদিন কে আদিবাসী বা কে বাঙালি এর পার্থক্য বুঝতেই পারিনি।সংকোচহীন ভাবে সে সবার সাথে মিশতো কাউকে পার্থক্য করেছে বা কাউকে অমর্যাদা অপমান করেছে এমন দেখিনি। সেই মনোভাবটাও ছিল না।
৫.
কেমন করে এত সহজেই সবাইকে সমান চোখে "মানুষ" হিসাবে দেখে/ দেখেছে। যা সত্যিই অবিশ্বাসযোগ্য।তবে এইটা সত্য যে, সে এমনি;তার কাছে সবাই সমান।ক্যাম্পাস জীবন তিন বছর বেশি হতে চললো তবুও তার ভাবনা ধারা একি আছে।আমি পরিবর্তন হতে দেখিনি।তবে ভবিষ্যতে হবে কিনা বলতে পারবো না।বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমার দেখা ব্যাচম্যাট (বন্ধু), যে সারাজীবন আমার স্মরণে থাকবে সে 'বর্ষা রায় চৌধুরী'। সে ছোটখাটো মানুষ হলেও মন বিশাল বড়,মন অনেক সুন্দর।খুব সুন্দর কবিতা আবৃত্তি করে, আড্ডার সময় অনেকবার শুনিয়েছিল। আরো ভালো উপস্থাপনা করতে পারে।বলতে হয়,অনেক মানে বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শী।সে দকমান্দা(গারোদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক),পিনন(চাকমাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক) পড়েছিল,সহজেই মানিয়ে নিতে পেরেছিল। ক'জন কে ক্যাম্পাসে পরিধান করতে দেখেছি!!তাও গুটিকয়েক, তার মধ্যে সে একজন।এবং আদিবাসীদের বিভিন্ন উৎসব কিংবা যেকোন প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করতো নিজের সব্বোর্চটুকু ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার জায়গা থেকে।এবং তার মতো ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও ইতিবাচক মনোভাব পোষণকারী ক'জনের মধ্যে থাকে বা আছে!!
৬.
একটা স্মরণীয় ঘটনা বলি।সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি।তাই নিয়মিত কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে যাওয়া হতো।কী কী বই আছে তা দেখতাম ও যেটা ভালো লাগে তা পড়তাম।তবে পছন্দের মতো বই পেতাম খুবই কম,যা খুঁজতাম সেটার সংখ্যা নেহাতি কম ছিল।তো একদিন আমি বই খুঁজছিলাম সেও সেদিন এসেছিল।বই খুঁজতে খুঁজতে আমাদের সামনাসামনি দেখা হয়েগেল। প্রথমেই সে প্রশ্ন করলো, তুমি জাডিল না!! আমিও হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলাম।বই সম্পর্কে একটু কথা হলো। পরের আর তাকে দেখিনি।মানে আমাদের আগে পরিচয় হয়েছিল। তবে নতুন ছিলাম বলে ভয়ের কারণে ভুলে গিয়েছিলাম কারণ র্যাগিং এর বিষয়টা ছিল।সেইজন্য কারো সাথে পরিচয় বা মিশতে সংকোচবোধ করতাম।
আমাকে অপরিচিত(পরিচয় হয়েছিল তবে ভুলে গিয়েছিলাম) কেউ এই রকম ভাবে প্রশ্ন করবে তা ছিল অপ্রত্যাশিত। সেই জন্য বেশি করে মনে আছে, সেই স্মরণীয় ঘটনা।
৭.
আপনাদের মনে হতে পারে,এই সমস্ত কথা আমি কেন বলছি!হয়তো আমি লম্বা করেছি।তবে আমার মনে হয়েছে তা বলা উচিত ছিল।যখন বুনিং(শীর্ষ রাকসাম) এর মাধ্যমে জানতে পারলাম বর্ষার বাবা মারা গিয়েছেন। তখন নিজের প্রতি বিশ্বাস হচ্ছিল না।সেই অবিশ্বাসের জায়গা থেকে যেন খবরটা মিথ্যা হয়। সেইজন্য আরেক বন্ধু ইমন( ইমন বিন আনোয়ার)কে জিজ্ঞাসা করলাম।যা শুনেছি সত্য কিনা?সেও তাই বললো ঘটনা সত্য।আমি নিশ্চুপ হয়েগেলাম।যখন পুরো ঘটনা শুনার সৌভাগ্য হলো তখন আরো খারাপ লাগলো। কেন না এমন কিছু শুনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।যা শুনেছি, তিনি বিনাচিকিৎসায় মারা গেলেন।যদি চিকিৎসা করা যেতো হয়তো তিনি এখনো বেঁচে থাকতেন।চিকিৎসা কিংবা স্বাস্থ্যখাতের অবস্থা সম্পর্কে আমরা কমবেশি সবাই জানি।সেই জন্য নতুন করে বলার প্রয়োজন মনে করছি না।
৮.
একদিকে ভাইরাস আরেকদিকে লকডাউন। এই যে অপ্রত্যাশিত ঘটনা কতটা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হতে পারে তা ভাবতেই গায়ে কাটা দিয়ে উঠে।তাই এখনো ফোন দেওয়ার সাহস পাইনি।যে বন্ধুটি ক'দিন আগে বাড়িতে বসে শর্টফিল্ম তৈরি করলো, একটি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করলো।তার মাথায় কী এখন ফিল্ম ঢুকবে? ভাইরাসের মধ্যেও যে স্বাভাবিক জীবন চলছিল, তা কী তেমনি থাকবে!যে মেয়েটি সবসময় হাসিখুশি থাকে, ভালো মনের মানুষ তার জীবনে অসময়ে অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে যাবে তা সত্যিই বেদনাদায়ক।
আরো বেদনাদায়ক যখন বিনাচিকিৎসায় প্রিয় মানুষটি মারা যায়।অনেক বার অনুরোধ করা সত্ত্বেও, তাদের কে পা পর্যন্ত ধরতে হয়েছে। তবুও মন গলেনি।সিলেটে নেওয়ার পথে মানুষটি মারা যায়।মারা যাওয়ার পরেও অনেক ফরমালিটির বিষয় আছে সেটাও যে প্যারাহীন ভাবে হয়েছে, তা বলতে পারিনা। কারণ কাকে দোষ দিবো সিস্টেম নাকি অন্যকিছু!!
৯.
আমার উচিত ছিল ফোন দেওয়া,আমি দিতে পারিনি।সাহস হয়নি।আমি প্রার্থনায় স্মরণে রাখতে চাই,বন্ধুটি আবার হাসিখুশি থাকবে,অনেক শর্টফিল্ম বানাতে পারবে হয়তো ভবিষ্যতে সিনেমা বানাবে ও এই বিপর্যয় থেকে কাটিয়ে উঠবে।ভবিষ্যত জীবনের জন্য সফলতা প্রত্যাশা করি।
১০.
প্রতি,
বর্ষা রায় চৌধুরী
বন্ধু,সবসময় ভালো থেকো।সবসময় হাসিখুশি থেকো।এই সংকটাপন্ন সময়টা কাটিয়ে উঠো।জীবনের সফলতা আসবে,এই প্রত্যাশা করি।
আদিবাসী নিয়ে কিছু না কিছু বানাতে হবে তা স্মরণে রেখো।আদিবাসী নিয়ে যে বইটা দিতে চেয়েছিলি ভুলে যেয়েও না কিন্তু।
ইতি,
জাডিল মৃ
No comments